ঢাকা, শনিবার, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ০২ আগস্ট ২০২৫, ০৭ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

মার্কিন শুল্ক নিয়ে সিদ্ধান্ত আজ, আশা দেখছে বাংলাদেশ

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১:১০, আগস্ট ১, ২০২৫
মার্কিন শুল্ক নিয়ে সিদ্ধান্ত আজ, আশা দেখছে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে দেশটির সরকার বাংলাদেশের ওপর কত হারে শুল্ক আরোপ করবে, তা নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে দেশটির বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে তৃতীয় দফায় আলোচনা করছে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল।

বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া সব পণ্যে নতুন করে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর দুই দফা আলোচনা হলেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি দুই দেশ।

এই দফার আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গড়ে ৫০ শতাংশ শুল্ক গুনতে হবে বাংলাদেশকে। ফলে তৃতীয় দফার শেষ দিনের আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত শুল্কহার কমানো নিয়ে ইতিবাচক ফল পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ট্রাম্প প্রশাসন যে যুক্তির কথা তুলে ধরে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশ সে জায়গাটি নিয়েই তিন থেকে চার মাস ধরে কাজ করেছে। আর সেটি হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং বাণিজ্যঘাটতি কমিয়ে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক করা। তবে এর আগের দুই দফা বৈঠকে যেসব বিষয় অমীমাংসিত ছিল, সেগুলোতে একমত হয়েছে উভয় দেশ। কোন দেশকে যুক্তরাষ্ট্র কী সুবিধা দিয়েছে বা দিতে যাচ্ছে, আলোচনার টেবিলে সেগুলো উত্থাপন করেছে বাংলাদেশ। চূড়ান্ত ফয়সালা শেষ দিনই হবে।

বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে একটি দল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করতে ওয়াশিংটনে রয়েছে। এই দলে আরও রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশি পণ্যে গত ২ এপ্রিল ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তিন মাসের জন্য এ সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প ৮ জুলাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের হার হবে ৩৫ শতাংশ, যা কার্যকর হবে ১ আগস্ট থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রপ্তানি করে। নতুন হার কার্যকর হলে তা ৫০ শতাংশে দাঁড়াবে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিয়োজিত প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা বলেছেন, বাংলাদেশ দলের সঙ্গে আলোচনায় শুল্ক ও বাণিজ্যবিষয়ক কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ। আর বাংলাদেশের দিক থেকে দর-কষাকষির পুরো বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস।

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রথম দিনের আলোচনা শেষ হলো। এ ধরনের ক্ষেত্রে সাধারণত এত দ্রুত ফল আসে না। তবে যেসব বিষয় ও শর্ত ছিল, এইটুকু বলতে পারি যে সেগুলো নিষ্পত্তির বিষয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি।

সম্প্রতি বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আগামী পাঁচ বছরে দেশটি থেকে সাত লাখ টন গত আমদানি করা হবে। এ ছাড়া সয়াবিন ও তুলা আমদানি বাড়ানোরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানি থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে বোয়িং থেকে ১৪টি বিমান কেনার আদেশ ছিল, পরে ২৫টা করেছি।

যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার আগে প্রতিনিধিদলের সদস্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, চুক্তির ক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। পহেলা আগস্টের আগেই একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর কথাও বলেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং গত মঙ্গলবার রাতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এ পর্যন্ত আলোচনায় যে অগ্রগতি হয়েছে, তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ এ দফার আলোচনায় ইতিবাচক ফলাফল আশা করছে।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি পর্যায়ে দেশটি থেকে বছরে সাত লাখ টন করে গম কেনা হবে পাঁচ বছর ধরে। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। এক সপ্তাহ আগেই ২ লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি। দেশটি থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বৃদ্ধির পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি বোয়িং থেকে কেনা হবে ২৫টি উড়োজাহাজ। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেসরকারি খাত যাতে তুলা, সয়াবিন বীজ, ডাল ইত্যাদি পণ্য আমদানি বাড়াতে পারে, সে ব্যাপারে নীতি সহায়তা দেবে সরকার।

এদিকে ব্যবসায়ীদের একটি দলও আলাদাভাবে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। দলে রয়েছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, বিটিএমএ’র দুই পরিচালক মোশারফ হোসেন ও মাসুদ রানা, এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আমিরুল হক, তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল মিলসের পরিচালক চৌধুরী মোহাম্মদ হানিফ শোয়েব প্রমুখ।

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আমিরুল হক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন বীজ ও এলপিজি আমদানি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আমরা দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করছি। আমরা বর্তমানে যে পরিমাণ সয়াবিন বীজ আমদানি করি সেটা আগামী দুই বছরের মধ্যে তিনগুণ হবে।  

তিনি বলেন, দ্বিপাক্ষিক আলোচনা মাধ্যমে আমরা আশা করছি, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যেসব বাধা এবং আমদানি- রপ্তানিতে যে গ্যাপ আছে সেগুলো কমে যাবে। আমরা ওয়াশিংটনের যেসব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা আছে, যারা সয়াবিন বীজ ও এলপিজি উৎপাদন ও বিপণনের সরবরাহ চেইনের সঙ্গে জড়িত, তাদের সবার সাথে আলোচনা করছি। সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হবে। আমরা মনে করছি, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।

এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কিছু পলিসি সাপোর্টের প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে মাতারবাড়িতে টার্মিনাল করতে দেওয়া উচিত। আমরা যদি বড় জাহাজ নিতে পারি তাহলে লাইটারে করে সারা দেশে পণ্যগুলো দেওয়া যাবে। বিশেষ করে এলপিজি নিরাপদে দেওয়া যায়। এসব বিষয় আলোচনা করেছি নিজেদের মধ্যে। বাংলাদেশ সরকারকেও এসব বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া দরকার। এতে আমাদের ট্রেড গ্যাপ কমবে ও আমাদের সম্পর্ক ভালো হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দীর্ঘদিন যারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করছেন, যোগাযোগ রাখেন তাদের এই প্রক্রিয়ায় আরও আগেই যুক্ত করা উচিত ছিল।

বাণিজ্য আলোচনার পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক দিকগুলো বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোর ওপর এই সিদ্ধান্তের প্রভাব কেমন হবে সেটিও গুরুত্বের সঙ্গে নজরে রাখার কথা বলছেন তারা।

এ বিষয়ে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন ডিসক্লোজার চুক্তি থাকায় এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে খুব একটা জানানো হয়নি। আশা করছি যে, কিছু কমবে, এখন কতটুকু কমবে? অন্ততপক্ষে ভিয়েতনামের কাছাকাছি (২০ শতাংশ) আসতে পারি কি না। এরই মধ্যে কতগুলো প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে, আরও কিছু প্রস্তাবনা ইউএসটিআর-এর সঙ্গে তৃতীয় দফার আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে।

তিনি বলন, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এক্ষেত্রে বড় একটা স্টেকহোল্ডার। তারা যখন এটি মূল্যায়ন করবে তখন কেবল বাণিজ্যিক বিষয়গুলোই গুরুত্ব পাবে তা নয়, তাদের চিন্তায় ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতির বিষয়গুলোও থাকবে। বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কও তাদের বিবেচনায় থাকবে।

বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট বৈশ্বিক রপ্তানির ১৭ থেকে ১৮ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্রে। আর্থিক পরিমাণে যা প্রায় আট বিলিয়ন ডলার। বাড়তি শুল্ক আরোপের ফলে এই খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে বলেই মনে করে খাত সংশ্লিষ্টরা। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অন্যান্য রপ্তানি পণ্যেও। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তার মধ্যে রয়েছে–কৃষিপণ্য যেমন, খাদ্যশস্য, বীজ, সয়াবিন, তুলা, গম ও ভুট্টা। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি এবং লোহা ও ইস্পাত পণ্যও আসে বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে আছে—তৈরি পোশাক, জুতা, টেক্সটাইল সামগ্রী ও কৃষিপণ্য।

ইউএসটিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৬০ কোটি ডলার। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে ৮৪০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ।

অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আমদানি নীতি পরিবর্তন করে নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার তুলে নেওয়া ছাড়াও বন্দর ব্যবস্থাপনাসহ অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এছাড়া এই শুল্কনীতির প্রভাব কী হতে পারে, সেটিও পর্যালোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ভিয়েতনাম ২০ শতাংশ, জাপান ১৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ১৯ শতাংশ ও ফিলিপাইন ১৯ শতাংশ শুল্কহার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে ১৫ শতাংশে।

জিসিজি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।