২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিভীষিকাময় দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার পতনের দিনে যখন লাখো জনতা ‘মার্চ টু ঢাকা’ আন্দোলনের মাধ্যমে রাস্তায় নেমে আসে, তখন সরকারের দমন-পীড়নের মাত্রা পৌঁছায় চূড়ান্ত সীমায়।
গত বছরের জুলাই আন্দোলনের নৃশংস ঘটনাগুলোর সঙ্গে ৫ আগস্টের ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে। এই মামলায় আসামি করা হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে। যদিও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এরইমধ্যে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
ফরমাল চার্জ মোট ১৩৫ পৃষ্ঠার। এই ফরমাল চার্জ আদালতে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. আব্দুস সোবহান তরফদার, মো. মিজানুল ইসলাম। যেটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সেই চার্জের ভিত্তিতে ৩ আগস্ট থেকে বিচারও শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমের তথ্য ও তদন্ত প্রতিবেদন থেকে ঘটনা তুলে ধরা হয়।
নথি ও গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, সকাল থেকেই সেনাবাহিনী জানত শেখ হাসিনার শাসনের অবসান ঘটেছে, কিন্তু হাসিনা অনুগত পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য বাস্তবতা অস্বীকার করে প্রাণপণে গণবিপ্লব রুখে দেওয়ার চেষ্টা করে।
শহরের বিভিন্ন প্রবেশপথে ও কেন্দ্রস্থলে পুলিশের আর্মড ইউনিট ও আনসার সদস্যরা ছাত্র ও সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে প্রাণঘাতী রাইফেল ও শটগানের গুলি ছোড়ে। চানখাঁরপুল, শাহবাগ, রামপুরা ব্রিজ, বাড্ডা, মিরপুর, আজমপুর, আশুলিয়া ও গাজীপুরসহ প্রতিটি স্থানে রক্তাক্ত লাশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে, যাদের অধিকাংশই ছিল কিশোর বা শিক্ষার্থী।
রাজধানীর চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে ৬ ছাত্র-জনতা শহীদ হন। আশুলিয়াতে পুলিশের ভয়াবহতা চরমে পৌঁছে। সেখানে বহু সংখ্যক নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়। এরমধ্যে ছয়জনকে (যাদের মধ্যে একজন জীবিত ছিল) পরে লাশ পুড়িয়ে দিয়ে পৈশাচিকতার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
গাজীপুরে এক রিকশাচালককে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে মরদেহ গুম করে ফেলা হয়, আর আশুলিয়ায় ১৬ বছর বয়সী এক ছাত্রকে গুলি করে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়া হয়।
এমনকি ১২ ও ১৪ বছরের কিশোরদের দেহও ছিল পুলিশের লক্ষ্যবস্তু, যাদের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায় শটগানের গুলিতে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ কারও পরিচয় না জেনেই, কোনো হুমকি ছাড়াই যাকে দেখেছে তাকেই গুলি করেছে, যেন শহরজুড়ে বুলেটের বৃষ্টি চলছিল।
মর্মান্তিকভাবে, কিছু এলাকায় পুলিশ গুলিবিদ্ধ মরদেহ পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে এমন এক বীভৎস পরিস্থিতি তৈরি করে যাতে জনগণ ভেবে নেয় এই প্রাণহানির জন্য দায়ী তারাই, যারা প্রতিবাদ করছিল। ৫ আগস্ট ছিল মুক্তির সূচনা, কিন্তু সেই দিনটি রঙিন হওয়ার বদলে রঞ্জিত হয়েছিল রক্তে এটি ছিল হাজারো মায়ের কান্নার দিন, এক নিষ্ঠুর শাসকের শেষ মুহূর্তের হিংস্র ছোবল।
এই দিন সারা দেশে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার নির্দেশে তার অনুগত পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন সমূহের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন শহর ও অঞ্চলে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে হামলা চালালে শতশত মানুষ নিহত হয়, হাজার হাজার মানুষ গুরুতর জখমপ্রাপ্ত হয়।
নির্বিচারে হতাহতের এসব ঘটনাসহ জুলাই আন্দোলনের পুরো ঘটনায় যৌথ দায় হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিবন্ধন (১২৭ নম্বর) করা হয়। ওই অভিযোগের প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক মো. জানে আলম খান।
পরে তদন্ত করেন উপপরিচালক মো. আলমগীর (পিপিএম)। সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনার মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এ মামলায় ৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান রয়েছে।
৫ আগস্টের পর ট্রাইব্যুনালে গত ২৫ জুন পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে এক আসামির।
ইএস/আরএইচ