জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও সীমিত জমিতে বেশি ফলনের আশায় কৃষকেরা ঝুঁকছেন বিদেশি কোম্পানির হাইব্রিড বীজের দিকে। এতে স্বল্পমেয়াদে ফলন বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।
হাইব্রিড ফসল উৎপাদনের খরচ যোগাতে বাড়ছে কৃষকের ঋণের বোঝা। একইসঙ্গে বাড়ছে পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি।
সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা শ্যামনগর উপজেলার ধুমনগর গ্রামের ৪৫ বছর বয়সী অল্পনা রানী ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করেছেন। বিয়ের পরও জমিতে কাজ ছাড়েননি। তবে দীর্ঘদিন কীটনাশক ব্যবহারের ফলে বর্তমানে তিনি চোখে কম দেখেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই ২০১২ সাল থেকে তিনি দেশি বীজে ঝুঁকেছেন।
তিনি বলেন, ‘দেশি বীজে জমিতে তেমন কীটনাশক দিতে হয় না, জৈব সারেই ফলন ভালো হয়। এই ধানের ভাত খেতেও স্বাদ বেশি, আর পুষ্টিগুণও অনেক। ’
এই মৌসুমে তিনি ৭ বিঘা জমিতে দেশি আমন ধান চাষ করেছেন। আশা করছেন প্রায় ১০০ মণ ধান পাবেন। এছাড়া ২ বিঘা জমিতে ঝিঙা লাগিয়েছেন, শীতকালে শিম ও লাউ চাষ করবেন। তার কাছে ধানের কয়েক প্রজাতিসহ ১৫ প্রজাতির শিমের বীজ ও লাউয়ের বীজ সংরক্ষিত আছে।
অন্যদিকে একই উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের কৃষক দীলিপ কুমার কম জমিতে বেশি ফলনের আশায় হাইব্রিড বীজ বেছে নিয়েছেন। ২ বিঘা জমিতে তিনি বীনা-৮ ধান রোপণ করেছেন। নভেম্বরের মধ্যে প্রায় ৪০ মণ ধান ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশা করছেন।
তিনি জানান, ‘দেশি বীজে ফসল খুব কম হয়, সংসারের খরচ ওঠে না। তাই হাইব্রিড চাষ করতে হয়। তবে কীটনাশক দিতে হয় বারবার। ’
হাইব্রিড চাষে স্বল্পমেয়াদে লাভজনক ফলন এলেও জমিতে বারবার কীটনাশক ছিটাতে হয়। এতে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের পাশাপাশি উপকারী কীটও মারা যাচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশের।
আর হায়বাতপুর গ্রামের ৭৫ বছর বয়সী কৃষক সিরাজুল ইসলাম এখনও দেশি ধানের বীজেই আস্থা রাখেন। দুপুরে ভাত খেতে বসে গর্ব করে জানান, তার ভাত দেশি বীজের ধানের চাল দিয়ে রান্না।
তার কাছে বর্তমানে ১৬৭ প্রজাতির ধানের বীজ সংরক্ষিত আছে, যার মধ্যে দাড়শাইল, পাটনাই, ঘুনসি, দুর্গাভোগসহ নানা নামকরা জাত রয়েছে। বাজারে এসব বীজ পাওয়া যায় না। তারা নিজেরাই জমিয়ে রাখেন এবং বিনিময় প্রথায় ব্যবহার করেন।
তিনি বলেন, ‘দেশি ধানে ফলন একটু কম হলেও কীটনাশক লাগে না। এতে আমাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, মাটিও উর্বর থাকে। ’
হাইব্রিড বীজের চক্করে ঋণের ফাঁদে কৃষক
সিপিআরডির (CPRD) ২০২৪ সালের রিপোর্টে দেখা গেছে, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দেশীয় জাতের ধান লবণসহিষ্ণু ও টেকসই। কিন্তু সংরক্ষণ না হওয়ায় কৃষকরা ঋণ ও নির্ভরশীলতার ফাঁদে পড়ছেন। এই অঞ্চলে কৃষকরা হাইব্রিড বীজের দিকে ঝুঁকছেন। হাইব্রিড বীজ একদিকে যেমন ফলন বাড়ায়, অন্যদিকে বীজ পুনঃব্যবহারযোগ্য নয়, ফলে কৃষককে বারবার নতুন বীজ কিনতে হয়। আবার হাইব্রিড বীজ বোনার পর সার ও কীটনাশক জমিতে বেশি লাগে। আর অল্প দুর্যোগেই জমিতে বোনা ফসল নষ্ট হয়ে যায়, এতে ঋণের বোঝা এবং করপোরেট কোম্পানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে।
সিনজেনটা, মনস্যান্টো, বিএএসএফ, বায়ার ক্রপ সায়েন্স, বহুজাতিক বীজ কোম্পানি সীডসহ নানা ব্র্যান্ডের বীজ ইতোমধ্যেই বাজারে ঢুকছে। কিন্তু এসব বীজের প্যাকেটে কোথাও বিএসটিআইয়ের অনুমোদন বা মান নিয়ন্ত্রণের সিল নেই। ফলে কৃষকরা ঝুঁকিতে পড়ছেন, কারণ মান যাচাই ছাড়াই হাইব্রিড বীজ আমদানি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে বীজ নিয়ন্ত্রণে ‘বীজ আইন ২০১৮’ কার্যকর রয়েছে। আইনে বলা আছে, কোনো বীজ বাজারে বিক্রি বা বিতরণের আগে জাতীয় বীজ বোর্ড ও বিএসটিআই থেকে অনুমোদন নিতে হবে। একইসঙ্গে প্যাকেটে উৎপাদক বা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম, উৎপাদনের সাল, মেয়াদ, অঙ্কুরোদ্গম হার, প্রক্রিয়াজাতকরণ তথ্য ও মান নিয়ন্ত্রণের সিলমোহর উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। আইন ভঙ্গ হলে জরিমানা, লাইসেন্স বাতিল এমনকি কারাদণ্ডের বিধানও রয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির এসব বীজের প্যাকেটে কোনো তথ্যই দেওয়া নেই এবং অনুমোদন ছাড়াই বাজারে প্রবেশ করছে। এতে কৃষকরা নিম্নমানের বা কম অঙ্কুরোদ্গমের বীজ কিনে ক্ষতির মুখে পড়ছেন, বাজারে ভেজাল ও নিম্নমানের বীজ বাড়ছে এবং সরাসরি বীজ আইন ২০১৮ লঙ্ঘিত হচ্ছে।
কৃষকরা হাইব্রিড বীজের জন্য ব্যাংক ঋণ নিচ্ছেন। এই ঋণ শুধু বীজ কিনতে নয়, অতিরিক্ত কীটনাশক ও সার ব্যবহারের খরচও পূরণ করার জন্য। ফলে আর্থিক চাপ বাড়ছে, জীবনযাত্রার মান নষ্ট হচ্ছে এবং প্রাকৃতিক ঝুঁকি ও ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা আরও বেড়ে যাচ্ছে, বলেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক)-এর শ্যামনগর উপজেলা ম্যানেজার মননজয় মন্ডল।
তিনি বলেন, দেশীয় বীজ সংরক্ষণ ও ব্যবহার ঋণের বোঝা কমাবে। লবণসহিষ্ণু ও খরা সহিষ্ণু দেশীয় ধান কম খরচে চাষযোগ্য। এছাড়া দেশীয় বীজ সংরক্ষণে সহায়তা দেওয়া এবং বাজারে দেশীয় বীজের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়েও জোর দেন তিনি।
তিনি বলেন, দেশীয় বীজ সংরক্ষণ ও ব্যবহার ঋণের বোঝা কমাবে। লবণসহিষ্ণু ও খরা সহিষ্ণু দেশীয় ধান কম খরচে চাষযোগ্য। এছাড়াও দেশীয় বীজ সংরক্ষণে সহায়তা দেওয়া এবং বাজারে দেশীয় বীজের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়েও জোর দেন তিনি।
গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, অধিকাংশ কৃষক কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হলেও, অর্থনৈতিক লাভের আশায় তারা এই রাসায়নিকের ব্যবহার অব্যাহত রেখেছেন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য, কৃষকদের জন্য নিরাপদ কীটনাশক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ, পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতির প্রচলন এবং কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
এই গবেষণাটি কৃষি ও জনস্বাস্থ্য খাতে নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করছে, যাতে কীটনাশক ব্যবহারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কৃষকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
পরিবেশবিদরা বলছেন, হাইব্রিড বীজে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এতে শুধু জমির মাটির উর্বরতা নষ্ট হয় না, জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ে।
পরিবেশবিদ ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘কীটনাশক জমির ভালো পোকা-মাকড় মেরে ফেলে, মাটির জৈব স্বাস্থ্য নষ্ট করে দেয়। আর এই ফসল আমাদের শরীর-স্বস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। কেননা অধিকাংশ কৃষকেরই নেই কীটনাশক দেওয়ার বিষয়ে জ্ঞান, কি পরিমান জমিতে কতটুকু কীটনাশক ছিঁটাতে হবে তা জানেন না অনেকেই। যে কারণে অতিরিক্ত কীটনাশক ও সার দেওয়া খাদ্যশস্য আমাদের মানবদেহের জন্যও হুমকি। সেক্ষেত্রে দেশি বীজের ফলনে পুষ্টি রয়েছে, তেমনি এটি আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্যও নিরাপদ। ’
কৃষিবিদরা বলছেন, দেশি বীজের ভেতরেই লবণসহিষ্ণু জাত রয়েছে যা উপকূলীয় এলাকায় টেকসই সমাধান হতে পারে। দেশি ধানে ফলন কম হলেও জলবায়ু সহিষ্ণু, পুষ্টিকর ও নিরাপদ।
সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কো-অর্ডিনেটর ড. এবিএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘হাইব্রিড বীজ আসলে কৃষকের জন্য লোকসানের একটি জিনিস, এটি অনেক সময় চিটা হয়ে যায়। তখন সেই বছর কৃষক ধানের ফলন পায় না, অযথাই ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়। সেইসঙ্গে এটি উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য আরও সংবেদনশীল, কারণ এটি লবণসহিষ্ণু নয়। সেই তুলনায় কিছু দেশীয় বীজ কিন্তু লবণসহিষ্ণু। যেমন, দাড়শাইল ও পাটনাই। এছাড়া হাইব্রিডে যেমন ফলন বেশি তেমনি খরচও বেশি, সার লাগে বেশি আর অল্প প্রাকৃতিক দুর্যোগেই ঝরে পড়ে। ’
চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কৃষকদের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে
বাংলাদেশে ৩০টি কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল রয়েছে। হাইব্রিড বীজের কারণে খাবারের সংস্কৃতি ভেঙে যাচ্ছে, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবেও গ্রামীণ জীবন ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান কৃষি গবেষক পাভেল পার্থ। চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কৃষকদের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
১৯৯৮ সালের বন্যার পর হাইব্রিড বীজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া হলেও কৃষকরা সরাসরি আমদানি করছে না, বরং বিদেশি কোম্পানিই পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। সেনজেন, মনস্যান্টো, বিএসএফসহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে বীজ খাতকে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই সংকট উত্তরণের জন্য বীজ আইন সংস্কার করে এ খাতকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রাখার কথা বলেন পাভেল পার্থ। প্রতিটি ইউনিয়নে বীজাগার গড়ে তোলার পাশাপাশি নারী কৃষকদের বীজ সংরক্ষণে প্রণোদনা দেওয়া এবং জাতীয়ভাবে বীজ ব্যাংক স্থাপন করার দিকে জোর দেন এ গবেষক।
তিনি মনে করেন, স্থানীয় কৃষকদের সম্পৃক্ত করে বীজ পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। বীজের বিজ্ঞাপন বাতিল ও বিদেশি কোম্পানির আধিপত্য রোধের যে দাবি উঠেছে তা আমলে নিতে হবে।
বারসিক- এর শ্যামনগর উপজেলা ম্যানেজার মনঞ্জয় মন্ডল বলেন, ‘বাজারে হাইব্রিড বীজের প্রভাব বাড়ায় কৃষকরা করপোরেট কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। এতে করে বৃহৎ পরিসরে হাইব্রিড বীজের আগ্রাসনে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের কৃষির ঐতিহ্যবাহী জাত। আর তাই কৃষকের হাতে বীজের নিয়ন্ত্রণ ফেরানো, দেশীয় বীজ সংরক্ষণ ও টেকসই কৃষি নীতি বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। ’
বিশেষজ্ঞদের দাবি, একটি বীজের সঙ্গে কৃষি ও গ্রামীণ জীবনের অন্তত দশটি দিক জড়িয়ে আছে। হাইব্রিড ধান থেকে খড় মেলে না, ফলে গবাদি প্রাণীর খাদ্য সংকট তীব্র হচ্ছে। রাসায়নিক নির্ভর কৃষি দেশীয় প্রজাতির মাছ ধ্বংস করছে। আবার হাইব্রিড বীজ চাষের সিদ্ধান্ত সাধারণত পুরুষরা নেয়, এতে কৃষিতে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে, যা নারীর ক্ষমতায়নের অন্তরায়।
এনডি