ঢাকা: দুই দিনের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিরঙ্কুশ বিজয় নতুন করে আলোচনায় এনেছে ছাত্ররাজনীতির গতিপথ। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে শিবিরের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন তাদের সাংগঠনিক শক্তি এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে স্পষ্ট করে তুলেছে।
নির্বাচনে জাকসুতে ভিপি পদ ছাড়া বাকি ২৪টি পদের মধ্যে ২০টিতেই শিবির জয়ী হয়েছে। এতে ওই ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে এক শক্তিশালী অবস্থানে এসেছে তারা। এর আগে ডাকসুতেও ভিপি, জিএস, এজিএসসহ ২৩টি পদে জয় পেয়েছে শিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’র প্রার্থীরা। এই ধারাবাহিক সাফল্য দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে কোণঠাসা থাকা জামায়াতে ইসলামীকে বড় আশা দেখাচ্ছে।
জামায়াত নেতারা এই বিজয়কে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার এবং সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতির সূচনা হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন, এই সাফল্য ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
জামায়াত নেতারা বলছেন, এই ফলাফলের মাধ্যমে বোঝা যায় দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। এর ধারাবাহিকতায় দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলের পর জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে একটি পোস্ট দেন। তিনি বলেন, ‘মহান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ ভরসা, সত্যের ওপর অটল থাকা এবং প্রিয় জনগণের ভালোবাসা ও সমর্থনের ওপর আস্থাই আমাদের শক্তি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান নির্বাচন জাতির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনুক— মহান রবের দরবারে এটিই কামনা। ’
জাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর রোববার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাতে জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তরের সেক্রেটারি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম ফেসবুকে লেখেন, ‘ডাকসু থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এদেশের মানুষ ইসলামের পক্ষে রায় দেবে, ইনশাআল্লাহ। ’
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ডাকসু ও জাকসুতে এই ধারাবাহিক সাফল্য নিঃসন্দেহে ইমেজ তৈরির জন্য ব্যবহার করতে চাইবে জামায়াতে ইসলামী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে ভূমিকা, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারসহ নানা কারণে ফ্যাসিবাদের সময়ে কোণঠাসা থাকা দলটি এই বিজয় তরুণ প্রজন্মের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ হিসেবে নেবে। তবে এই বিজয় ধরে রাখা এবং শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণের চ্যালেঞ্জও তাদের সামনে রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর দিলারা চৌধুরী বলেছেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে জায়ামাত ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির ইতিবাচক কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের কাছে গিয়েছে এবং সেটাতে তারা সফল হচ্ছে। তাদের এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ মনে করেন, দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের পরিচয় দিলে হত্যা করা হতো সেখানে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল। এর মাধ্যমে বোঝা যায় দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে।
তিনি বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ইসলামী ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে তাদের গঠনমূলক কাজ নির্বিঘ্নে করতে পারায় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে প্রভাব পড়েছে। আমরা আশা করি নবনির্বাচিত প্রতিনিধিরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার শ্রেষ্ঠ পরিবেশ বজায় রাখতে সবাইকে নিয়ে কাজ করবে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বাংলানিজকে বলেন, জনগণের মতামতের প্রতিফলন এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির জন্য ছাত্র নির্বাচনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা এখন গঠনমূলক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, যা ৫ আগস্টের পর স্পষ্ট হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই বিজয়ের পর ছাত্রশিবিরের ওপর একটি বড় দায়িত্ব এসেছে। তাদের এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে এবং তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।
জামায়াতের এই কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ছাত্র নির্বাচনের এই ফলাফল প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনকে সামনে রেখে জামায়াত ইসলামী যে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির পক্ষে জোর দিয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। এই পদ্ধতি সংসদীয় ব্যবস্থায় ফ্যাসিবাদ বা একনায়কতন্ত্র প্রতিরোধ করবে এবং সব দলের ভোটের সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করবে।
এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ছাত্র নির্বাচনের ফলাফলকে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন এবং তিনি বিশ্বাস করেন, এর মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সাম্প্রতিক ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসে একটি রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। ছাত্রদল, বামপন্থী ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো যখন তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, প্রথাগত কর্মকাণ্ড ও কৌশলগত ভুলের কারণে জনসমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, তখন ছাত্রশিবির কৌশলী ও সংগঠিতভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। নির্বাচনের প্রায় এক বছর আগে থেকেই তারা ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক কাজ শুরু করে। শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে কাজ করা এবং তাদের মধ্যে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে তারা সফল হয়।
জাকসুতে বিজয়
১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ২৫টি পদের মধ্যে ২১টিতেই বিজয়ী হয়েছেন শিবির সমর্থিত প্রার্থীরা।
জিএস পদে শিবিরের প্যানেলের মো. মাজহারুল ইসলাম এবং এজিএস পদে ফেরদৌস আল হাসান ও আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা নির্বাচিত হয়েছেন।
ভিপি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রশিদ (জিতু) নির্বাচিত হলেও বাকি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে শিবিরের জয় ছিল চোখে পড়ার মতো।
শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক, পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক, সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক, সহ সাংস্কৃতিক সম্পাদক, নাট্য সম্পাদক, সহ-ক্রীড়া সম্পাদকসহ প্রায় সব সম্পাদকীয় পদে এবং কার্যকরী সদস্য পদগুলোতে শিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’র প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছেন। এই ফলাফল জাকসুতে তাদের শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তিকে প্রমাণ করেছে।
ডাকসুতে সাফল্য
জাকসু নির্বাচনের আগেই ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা গেছে। ডাকসুর ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টিতে জয়ী হয়েছেন শিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্রার্থীরা।
এর মধ্যে ভিপি পদে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ আবু সাদিক কায়েম, জিএস পদে এস এম ফরহাদ এবং এজিএস পদে মুহা. মহিউদ্দীন খান নির্বাচিত হয়েছেন।
অন্যান্য সম্পাদকীয় পদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক, ক্রীড়া, ছাত্র পরিবহনসহ প্রায় সব পদে তাদের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। ১৩টি সদস্য পদের মধ্যে ১১টিতেই শিবিরের প্যানেল থেকে সদস্যরা নির্বাচিত হয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের ভাবনা
নির্বাচনী ফলাফল প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা এমন একটি নেতৃত্ব চেয়েছিলাম যারা আমাদের একাডেমিক এবং ক্যাম্পাসের সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করবে, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করবে না। শিবিরকে আমরা তুলনামূলকভাবে কম বিতর্কিত এবং বেশি সুশৃঙ্খল দেখেছি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, দীর্ঘদিন পর জাকসু নির্বাচন হওয়ায় আমরা চেয়েছিলাম সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব, যারা ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কাজ করবে। ছাত্রশিবির সেই দিক থেকে নিজেদের একটি ‘ক্লিন ইমেজ’ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের কাছে সহজে পৌঁছাতে পেরেছে।
ইএসএস/টিএ/এইচএ/