শিবু কুমার শীল। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বইয়ের প্রচ্ছদ করছেন।
বাংলানিউজ: কেমন আছেন?
শিবু কুমার শীল: ভালো।
বাংলানিউজ: এবার মেলায় কতোগুলো বইয়ের প্রচ্ছদ করছেন?
শিবু কুমার শীল: এখনও গোনা হয়নি। খুব বেশি হলে পঞ্চাশটির মতো হবে।
বাংলানিউজ: প্রাসঙ্গিকভাবেই জানতে চাই, বইয়ের প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে আপনি কি পাণ্ডুলিপি পড়ে থাকেন বা পাণ্ডুলিপি পড়া দরকার বলে মনে করেন?
শিবু কুমার শীল: প্রচ্ছদ করার জন্য পাণ্ডুলিপি পড়ার দরকার নেই। অন্তত আমার মনে হয় আরকি। তবে বইয়ে কী আছে সেটা যদি লেখক বা প্রকাশক আমাকে বলে দেন তাতেই চলে। ধরেন, ‘ছাগল পালন’ বা ‘মুরগির রানীক্ষেত রোগে করণীয়’- বইয়ের নাম এমন হলে আমরা বেশি খুশি হই। তখন অনায়াসেই কাভারটি করে ফেলা যায়। সিনোপসিসও লাগে না। হা হা হা...।
বাংলানিউজ: আপনি পড়েছেন চারুকলায়। তো পড়াশুনা লব্ধ জ্ঞান কাজে লাগাতেই প্রচ্ছদ করছেন, নাকি প্রচ্ছদ শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে অন্য কোনো বিষয় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে?
শিবু কুমার শীল: প্রচ্ছদশিল্পী কোনোদিন হতে চাইনি। আমি সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখি। প্রচ্ছদকে আলাদাভাবে কোনোদিন ভাবিনি। আমি গান গাই। মানে গাওয়ার চেষ্টা করি। ছবি আঁকি। অডিও ভিজ্যুয়ালেও কাজ করি। এই যে নানা মাধ্যমে কাজ করা- এর সমস্তটাই আমার কাছে এক সূত্রে গাঁথা। কোনো বিষয়ের থেকে কোনোটা এলিয়েনেটেড না। আমি পুরো বিষয়টা উপভোগ করি।
বাংলানিউজ: আপনার প্রচ্ছদে কালার ব্যবহার, ফন্ট, নামাঙ্কন, গ্রাফিক্সের ব্যবহার, হাতে আঁকা ছবির ব্যবহার- এসব ক্ষেত্রে আপনি কী কী বিষয় বিবেচনায় নিয়ে থাকেন? মানে আপনার হাতে কোনো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটা প্রচ্ছদ হয়ে ওঠে?
শিবু কুমার শীল: আমি একটা প্রচ্ছদ করতে বসার আগে তেমন ভাবি না। ভাবতে চাইও না। কারণ ভেবে ভেবে কাজ করতে পারি না আমি। আমার কোনো গান আমি আগে লিখিনি। মানে সুর করার আগে। বলতে পারেন, আমার গানের কোনো লিখিত রূপ নেই। এই যে মুখে মুখে গান বা কাজ করতে করতে ভাবা- এটাই আমার ওয়ার্ক প্রসেস। আমি আর্টেও স্পন্টিনিটিকে বিলিভ করি। মানে, ঘোষণা দিয়ে শিল্প করা আমার দ্বারা হয় না। অবশ্য যা করি তা শিল্প কিনা সেইটাও আরেক বিচারের বিষয়। বুক কভারের ক্ষেত্রে আই নিড এ ইন্সপারেশন ফ্রম বুক টাইটেল। এবং সেই টাইটেলটাই আমাকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নেয়। প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে আমি বইয়ের শিরোনামকে অনুসরণ করি মাত্র।
বাংলানিউজ: একটা বই প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, প্রচ্ছদ যার একটা পার্ট। এক্ষেত্রে বই প্রকাশের অন্যান্য পর্যায়ের সঙ্গে প্রচ্ছদের সংশ্লিষ্টতা ও পুরো প্রক্রিয়ায় একজন প্রচ্ছদশিল্পীর সামগ্রিক ভূমিকা বা অংশগ্রহণ কী বলে মনে করেন?
শিবু কুমার শীল: একটি বই প্রকাশিত হওয়ার যে প্রক্রিয়া তার মধ্যে প্রচ্ছদশিল্পীর মারাত্মক ভূমিকা আছে। বলা যেতে পারে, এক্ষেত্রে তার ভূমিকা অনেকটা জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ টাইপ। বইটি কীভাবে বাঁধাই হলে ভালো লাগবে, সেই জায়গাতেও শিল্পীর ভূমিকা থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের প্রকাশনা শিল্পের যে অবস্থা তাতে শিল্পী এখানে প্রচ্ছদের বাইরে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেন না। সেই সুযোগও নেই। আমাদের প্রবীণ প্রচ্ছদ শিল্পীদের কাছে শুনেছি, তারা তাদের কাজটি কীভাবে প্রিন্ট হচ্ছে সেটাও তদারকি করতেন।
বাংলানিউজ: টেক্সটকে বিবেচনা করে যেহেতু প্রচ্ছদ আঁকতে হয়, ফলে প্রচ্ছদশিল্পী কি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিতে পারেন? এক্ষেত্রে লেখকের কোনো মত কি থাকতে পারে? অর্থাৎ, লেখকের সঙ্গে প্রচ্ছদশিল্পীর মিথষ্ক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত?
শিবু কুমার শীল: এইটা ইন্টারেস্টিং পার্ট। আমি মনে করি, প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে লেখকের কোনো স্পেসিফিক প্ল্যান না থাকলে সেটা শিল্পীর ওপরেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। অন্যথায় কাজটা নষ্ট হয়। কেউ কেউ মনে করেন- আমি লেখক। আমি এই লেখার মালিক, আমাকেই সব বলতে হবে। এটা ঠিক না। এই দায়িত্বটুকু শিল্পীর ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। একটা ভালো কাভারের জন্য দরকার একটা পেশাদারি প্রক্রিয়া। ভালো রেমুনারেশন এখানে মুখ্য। শিল্পীর সঙ্গে লেখকের যুগলবন্দি এখানে অপরিহার্য নয়। ধরেন, একটা কাভারের জন্য আমার একটা ফটোগ্রাফ লাগবে। সেই ফটোগ্রাফটা আমি যদি পেশাদারি জায়গা থেকে ব্যবহার করতে চাই, তার জন্য কিন্তু কোনো বাজেট থাকে না। ফলে একটা কম্প্রোমাইজ প্রচ্ছদ শিল্পীকে করতেই হয়। এই আরকি।
বাংলানিউজ: প্রচ্ছদকে কি আপনি শিল্প হিসেবে দেখেন? একটা বইয়ের ক্ষেত্রে প্রচ্ছদ কতোটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
শিবু কুমার শীল: প্রচ্ছদ শিল্প কিনা কীভাবে বলি? তবে প্রচ্ছদ একটা ডিপেন্ডেন্ট আর্ট ফর্ম। আমি চাইলেই সেইখানে যা ইচ্ছা তা করতে পারি না। আরেকজনের কন্টেন্টকে বেজ করে আমাকে কাজটা করতে হয়। তবে দিন শেষে একটা ভালো প্রচ্ছদশিল্প হয়ে উঠতেই পারে। এ বিষয়ে কোনো ডগমাটিক অবস্থান আমার নেই।
বাংলানিউজ: এবার বইমেলা কেমন হচ্ছে? আয়োজন কেমন বলে আপনার মনে হয়?
শিবু কুমার শীল: বইমেলার আয়োজন অ্যাজ ইউজুয়াল। যেরকমটি হয় সবসময়। তবে আমার মনে হয় বইমেলায় বই বিক্রির পাশাপাশি কিছু বই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো। আর বইমেলাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি বেশ পুরনো ফরম্যাটের। এর বদল দরকার। লেখক প্রকাশক আর পাঠক বা ক্রেতাদের ইন্টারঅ্যাক্টিভিটি হয়, এমন কিছু অনুষ্ঠান আয়োজন করা যেতে পারে।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশে প্রচ্ছদ শিল্পের অবস্থা এবং এ ব্যাপারে আপনার ভাবনা ও কর্মপন্থা বিষয়ে জানতে চাই।
শিবু কুমার শীল: প্রচ্ছদশিল্প নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলার নেই। প্রত্যেকের কর্মপদ্ধতি আলাদা। কেউ রং-তুলি দিয়ে প্রচ্ছদ করতে ভালবাসেন, কেউ ডিজিটালি, কেউ আবার দুটোরই সমন্বয় করেন। মানে এই যে বৈচিত্র্য এটাতো পজিটিভ। তবে গুগলের প্রভাব খুব বেশি আমাদের প্রচ্ছদে। যার কারণে ইউনিকনেসের ঘাটতি দেখা যায়। তাই একজন কাইয়ুম চৌধুরী প্রায় একই রকম কাজ করেও ইউনিক। আর ধ্রুব এষ আমার কাছে একটি বিস্ময়। এতো এতো প্রচ্ছদ করেও তিনি তার মান এখনও সমানভাবে বজায় রেখেছেন। এটা বিরল।
বাংলানিউজ: এক যুগ ধরে প্রচ্ছদ করছেন। এতো বছরের অভিজ্ঞতায় প্রচ্ছদ নিয়ে সার্বিকভাবে আপনার মূল্যায়ন কী?
শিবু কুমার শীল: প্রচ্ছদ মানে জ্যাকেট বা মোড়ক। এক ধরনের প্রেজেন্টেশন। ধরেন, আপনি আপনার প্রেমিকাকে আমার কাছে নিয়ে আসলেন। বললেন, তাকে যেন আমি সাজিয়ে দেই। খুব সেনসিটিভ বিষয়। আমরা প্রচ্ছদকাররা অন্যের প্রেমিকাকে সাজাচ্ছি। এতে পান থেকে চুন খসলে বিরাট মান-অভিমানের ঘটনা ঘটছে। লেখক কষ্ট পাচ্ছেন। সেইটা একজন শিল্পী হিসেবে আমাকেও ভীষণভাবে নাড়া দিচ্ছে। এটা কোনো সহজ কাজ নয়। তবে হ্যাঁ, একটা ভালো টেক্সট একটা ভালো প্রচ্ছদের অনুপ্রেরণা। আমি যখন ভালো কোনো কন্টেন্ট হাতে পাই, তখন আমার এই অনুভূতি হয় যে, এই প্রচ্ছদটি ভালো হলে এই টেক্সটির সঙ্গে সঙ্গে আমার কাজটিও থেকে যাবে। একটা আর্কাইভাল ভ্যালু ক্রিয়েট হবে। দ্যাটস ভেরি ইমপরট্যান্ট। সোজা কথা, একটা ভালো কনটেন্ট একটা প্রচ্ছদকে অমর করে।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের বেশির ভাগ প্রকাশকই মেলাকেন্দ্রিক, যাকে বলে মৌসুমী। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
শিবু কুমার শীল: এ আর নতুন কি। হ্যাঁ, মেলাকেন্দ্রিকতা থেকে বের না হলে চলবে না। সাম্প্রতিক সময়ের পরিসংখ্যান বলছে, উপমহাদেশে ই-বুক ফর্মটা ফ্লপ করেছে। এটা নেগেটিভ না পজিটিভ- সে তর্কে যাচ্ছি না। তবে এই অঞ্চলের মানুষের কাগুজে বইয়ের যে তৃষ্ণা, তা হয়তো এখনও অবশিষ্ট আছে। আর পেশাদারিত্ব সবক্ষেত্রেই দরকার। লেখক ঠিকমতো রয়্যালিটি পাবে, প্রচ্ছদশিল্পী তার পারিশ্রমকি পাবে, বাইন্ডারকে সারা বছর মাছি মেরে ফেব্রুয়ারি মাসে রাত জাগতে হবে না। প্রত্যেক প্রকাশনার একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকবে। আমাদের তখন আর পাইরেটেড সফটওয়্যার দিয়ে ডিজাইন করতে হবে না। তো এরকম আরও অনেক জায়গা আছে যেখানে আলো ফেললে বদলে যেতে পারে আমাদের প্রকাশনা শিল্প। যেটা সবারই কাম্য।
বাংলানিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ
শিবু কুমার শীল: আপনাকেও ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৬
আরএম/এএ