ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

প্রকাশকদের মাথায় হাত

ক্ষতি কোটি টাকা, অকেজো সিসি ক্যামেরা

আদিত্য আরাফাত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৬
ক্ষতি কোটি টাকা, অকেজো সিসি ক্যামেরা ছবি: আনোয়ার হোসেন রানা/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বইমেলা থেকে: দুপুরের প্রচণ্ড ঝড়ো বৃষ্টিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। কোনো প্রকাশনীর স্টলের ছাউনি উড়ে গেছে, কোনোটির আবার ছাউনি ভেঙ্গে শিলা বৃষ্টি পড়ে পুরো স্টল পানিতে টইটম্বুর, আবার কোনোটির পর্দা উড়ে ভেতরের সব বই ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।



এছাড়া মেলায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বেশিরভাগ সিসি ক্যামরা নষ্ট হয়ে গেছে। বের হয়নি নতুন কোনো বইও। এক ঘণ্টার জন্য মেলা খোলা হলেও ছিলো না বিদ্যুৎ। আগতরা এসে উল্টো ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।

বুধবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরের শিলা বৃষ্টিতে মাথায় হাত পড়েছে প্রকাশকদের। তাদের দাবি, মেলায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এদিকে মেলার দুয়ার বেলা ৩টার পরিবর্তে বিকেল সাড়ে ৫টায় খুলে সাড়ে ৬টায় বন্ধ হয়ে যায়।

এবারের বইমেলায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৮২টি প্রতিষ্ঠানের ১১১টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩২০টি প্রতিষ্ঠানের ৫৪০টি ইউনিট রয়েছে। মোট ৪০২টি প্রতিষ্ঠানের ৬৫১টি ইউনিট রয়েছে। এছাড়া উদ্যানে ১৫টি প্যাভিলিয়ন রয়েছে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রয়েছে ৯২টি লিটল ম্যাগাজিনের স্টল।

সরেজমিন মেলায় ঘুরে দেখা গেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাংলা একাডেমি প্রান্তে মোট ২শ’টি স্টল কম বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সময় প্রকাশনীর কর্ণধার তার প্যাভিলিয়নের সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা বই দেখিয়ে বলেন, ‘আনিসুল হকের ‘মা’ উপন্যাসটির ২শ’ কপি ভিজে গেছে। এ বইটির প্রতিটির মূল্য ২শ’ টাকা। এছাড়া অন্যান্য আরও কয়েক শ’ বই ভিজে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে প্যাভিলিয়নও।

মেলার ২৪তম দিনে অমর একুশে গ্রন্থমেলার দুই প্রাঙ্গণেই ছিলো থই থই পানি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পানি সেচছেন। তাতেও তেমন পানি সরছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলছিল সেচ। বাংলা একাডেমি তথ্যকেন্দ্রের মাইক থেকে ভেসে আসছিল, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মেলা সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নয়ন হলে বইমেলার কার্যক্রম আবার শুরু করা হবে। ’

মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভের দিককার টিন দিয়ে তৈরি বেষ্টনী উড়ে গেছে শিলাঝড়ে। অনেক স্টলের সাইনবোর্ডের নাম-নিশানাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক স্থানে হাঁটু পর্যন্ত পানি। সেই পানি প্রবেশ করেছে স্টলগুলোতে। স্টলগুলোর ভেতর ভেজা বইয়ের স্তূপ। যেগুলো সামান্য ভিজেছে সেগুলো শুকনো কাপড় দিয়ে মুছছিলেন বিক্রয়কর্মীরা। কাদায় হাঁটা যাচ্ছে না। অকেজো হয়ে যায় সিসিটিভি ক্যামেরাও।

জানা গেছে, মেলার নিরাপত্তায় থাকা ২০-২২টি সিসি ক্যামেরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এদিকে সিসি ক্যামেরা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় নিরাপত্তা নিয়েও একটা শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

প্রকাশকদের বক্তব্য, বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) মেলা খোলার আগেই যেনো অকেজো সিসি ক্যামেরা খুলে নতুন লাগানো হয়। এদিকে নতুন সিসি ক্যামেরা লাগানো হবে কি-না এ বিষয়ে নিশ্চিত করতে পারেননি মেলায় দায়িত্বরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

বুধবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকেই রাজধানীর আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে ছেয়ে যায় ঢাকা। ধারণা করা হচ্ছিল, বৃষ্টি নামতে পারে। গতরাতে ঢাকার আশপাশে ও আরও কয়েক জেলায় বৃষ্টি হওয়ায় এ ধারণা করছিলেন মানুষ। বেলা ১১টা ৪০ মিনিট থেকে ৫৭ মিনিট পর্যন্ত প্রবল শিলাবৃষ্টি ও সেইসঙ্গে ঝড়ো হাওয়ায় উড়েছে ঢাকা। মাত্র ৭ মিনিটের বৈরি আচরণে হতভম্ব হয়ে পড়েন নগরবাসী। আর সেই ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বইমেলা।

মৌসুমের এটিই ছিল প্রথম শিলাবৃষ্টি। শিলাখণ্ডের আকারও ছিল বেশ বড়। শিলাখণ্ডের আঘাতে বেশিরভাগ স্টলের সাইনবোর্ড ও নামফলক উড়ে যায়। অনেক স্টলের ছাদ ফুটো হয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে ভিজে যায় বই। কয়েক মিনিটের ওই ঝড়ো হাওয়া আর শিলাবৃষ্টির পর হঠাৎ করেই আকাশে হেসে ওঠে সূর্য। ঝলমলে আলো দেখে বোঝারই উপায় নেই, একটু আগেই কেমন সেজেছিল প্রকৃতি! এর কিছুক্ষণ পরেই আবার মুষলধারে বৃষ্টি নামে। সেই বৃষ্টির স্থায়িত্বকালও কম ছিল। তবে তার আগেই শেষ হয়ে যায় সব!

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও পশ্চিম ও পূর্ব পাশে গিয়েও দেখা গেল একই চিত্র। অন্যপ্রকাশ, অনন্যা, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল), সাহিত্যপ্রকাশ, শিকড়, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, শ্রাবণ প্রকাশনী, বিভাসসহ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের স্টলে পানি ঢুকেছে এবং বই নষ্ট হয়েছে।

অনন্যা প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী মনিরুল হক বলেন, ‘আমাদের প্রায় আড়াই লাখ টাকার মতো বই ভিজেছে। আমরা এখনও বইগুলো সরানোর কাজে ব্যস্ত আছি’।

অন্যপ্রকাশের বিক্রয়কর্মী তুহিন বলেন, ‘এতো সতর্ক থাকার পরেও শিলাবৃষ্টির কারণে আমাদের স্টলের ছাদ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং পানি পড়ে প্রচুর বই ভিজে গেছে। নষ্ট হয়েছে অনেক টাকার বই’।

ইউপিএলের বিক্রয়কর্মী মো. আল মামুন বলেন, ‘আমাদের ৮০ শতাংশ বই ভিজে গেছে। প্রায় ৫ লাখ টাকার মতো বই নষ্ট হয়েছে’।

সাহিত্যপ্রকাশের বিক্রয় ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের স্টলটির অবস্থা ভয়াবহ অবস্থা। লাখ তিনেক টাকার মতো বই নষ্ট হয়েছে’।

তবে বেশ কিছু স্টলে গিয়ে দেখা গেল বিপরীত চিত্র। তারা সতর্ক থাকায় বই ভেজেনি বা শিলাবৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারেনি স্টলগুলোকে।

আগামী প্রকাশনীর বিক্রয় ব্যবস্থাপক মিতিয়া ওসমান জানান, তাদের স্টলে খুব একটা ক্ষতি হয়নি। বলেন, ‘আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। বৃষ্টি তো প্রতিবছর বইমেলায় হয়’।

মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেন, ‘প্রস্তুতি শেষ। মেলার একপাশের সিসি ক্যামেরাগুলো অকেজো হয়ে আছে। সেগুলো চালু হলেই মেলা শুরু করা হবে’।

ইতোমধ্যেই প্রকাশকদের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের দাবি উঠেছে। ৭ দিন মেলা বাড়ানোরও দাবি তুলেছেন তারা। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, মেলার সময় বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তাদের সঙ্গে বিষয়টি আমরা আলোচনা করে দেখবো’।

বুধবার একঘণ্টার জন্য মেলার দুয়ার খুললেও বইয়ের টানে কয়েকশ’ মানুষ মেলায় এসেছেন। বৃষ্টিতে মেলার অবস্থা দেখে তারা আবার বের হয়ে গেছেন। এক ঘণ্টার জন্য মেলা খুললেও বইমেলার দুই প্রান্ত ছিলো বিদ্যুৎবিহীন। ক্ষতির শিকার হয়নি এমনি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চার্জলাইট ও মোমবাতি দিয়ে স্টল খুললেও বিক্রি হয়নি বললেই চলে।

মেলায় আসেনি নতুন বই
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বুধবার নতুন কোনো বই প্রকাশ পায়নি। মেলার মূলমঞ্চে পানি উঠে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমির ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভবনের আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তেন অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ও মান উন্নয়নে সমস্যা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক গবেষক আবুল মোমেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কাজী ফারুক আহমেদ, মনজুর আহমদ এবং শাহিনুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম। আলোচনার পর স্বল্প পরিসরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

বৃহস্পতিবারের আয়োজন
বাংলা একাডেমি জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার বইমেলার দুয়ার বেলা ৩টায় খুলবে। চলবে রাত ৮টা পর‌্যন্ত। বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলাদেশে নারী জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ড. মাসুদুজ্জামান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন মালেকা বেগম, সুলতানা কামাল এবং মুহম্মদ শহীদ উজ জামান। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম আক্তারী মমতাজ। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

বাংলাদেশ সময়: ২১১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৬
এডিএ/আইএ/এএসআর

** আড়াই ঘণ্টা দেরিতে খুলে ১ ঘণ্টা পর বন্ধ মেলা
** প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে খুললো বইমেলার গেট

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।