উত্তর আছে। আমি সোজাসাপ্টাভাবে বলতে চাই- অন্যদের দোষ দেখার আগে নিজেদের দিকে তাকান।
একটু ব্যাখ্যা করে যদি বলি, সেই যে কবেকার ঠাকুরমার ঝুলি, কিংবা সুকুমার রায়ের লেখা ছড়া, সীতানাথ বসাকের আদর্শলিপি, যতীন্দ্রমোহন বাগচী’র কাজলা দিদি কিংবা রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই শিশুদের জন্য খেলাঘর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু তারপর? তার আর পর নাই। নেই কেন?
বাংলাদেশে প্রতি বছর একুশে বইমেলায় ৩/৪ হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়। যার অধিকাংশই বড়দের জন্য কবিতা, উপন্যাস এবং গল্প। এছাড়া রাজনৈতিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এসবের বাইরে কিশোরদের জন্য শাহরিয়ার কবির এক সময় লিখেছিলেন। তিনি ছাড়া মুহম্মদ জাফর ইকবাল নিরলসভাবে লিখছেন এবং দারুন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তার সফলতা দেখে অনেক প্রকাশক এবং তরুণ লেখকও এখন কিশোরদের জন্য বই লিখতে এবং প্রকাশ করতে উৎসাহিত ও মনোযোগী হয়েছেন। বলতে গেলে জাফর ইকবাল যদি কিশোরদের জন্য না লিখতেন, তাহলে আমাদের কিশোরদের জন্যও তেমন কোনো বই পাওয়া যেতো না।
জাফর ইকবালের আগমনের আগে বাংলা সাহিত্যে কিশোর উপন্যাস ছিল মামা-চাচা কেন্দ্রিক হিরো চরিত্র প্রধান। এখন সেই বেহাল দশা কেটেছে, মামা-চাচার কাছ থেকে সায়েন্স ফিকশনের দিকে যাত্রা করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে শিশুদের জন্য (যাদের বয়স ১০ বছরের নিচে) কে বা কারা লিখেন? আপনি দুই/চারজন লেখকের নাম বলতে পারবেন? আমি নিশ্চিত, এটা খুব সহজ হবে না। কারণ আমাদের দেশে শিশুদের জন্য কবি-লেখকরা তেমন করে ভাবেন নাই, লিখেন নাই। এক সময় টোনাটুনির গল্প এসেছিল বইসহ অডিও নিয়ে। তাও কিন্তু দুই-আড়াই দশক আগের কথা। সেই টোনাটুনির গল্প কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তাই আমরা এখন কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না, কারো নাম মনে করতে পারছি না। এটা খুবই দুঃখজনক। তাই না?
এমন দুঃখজনক অবস্থার কারণেই আজকে বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বই-পুস্তকে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন চলে এসেছে। যেসব কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী আজকে সমালোচনায় সরব হয়েছেন, তাকেই জিজ্ঞেস করুন, ‘আপনি তো অনেক বই লিখেছেন কিন্তু শিশুদের জন্য কয়টি লিখেছেন? আজকে বাজারে শিশুদের জন্য ভালো বই পাওয়া যায় না কেন? এর দায়-দায়িত্ব কি আপনার উপরও বর্তায় না? যখনই কোথাও শূন্যতা তৈরি হবে, সেখানে ভালো হোক, মন্দ হোক কিছু না কিছু এসে জায়গা দখল করবেই।
কয়েক বছর আগে ডরিমন নামক এক জিনিস এসে বাংলাদেশে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে দিয়েছিল। অনেক কষ্টে তা বিতাড়িত করা হয়েছে। এখন ডরিমন গেছে কিন্তু অন্য জিনিস এসেছে। অবস্থা এমন যে, সাগর পেরিয়ে উঠিলাম গাছে, ভূত বলে পাইলাম কাছে। এভাবে চলতে থাকলে আজকে ‘ও’ তে ওড়না হয়েছে, কালকে ‘প’ তে পায়জামা হবে, পরশুদিন ‘ব’ তে কি হবে? আপনিই অনুমান করুন। আমি আর কিছু বলতে চাই না।
আরেকটি বিষয়- আপনি নিশ্চয়ই বাংলাদেশে রেলস্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে হকারদেরকে বই বিক্রি করতে দেখেছেন, তাই না? তারা শিশুদের বই বিক্রি করে। সেই বইগুলি কেমন? শুধুমাত্র কতগুলি পশু, পাখি, মাছ, ফল, ফুলের ছবি, তাই না? সেখানে কি কোনো গল্প আছে? শিশুদের কল্পনাকে প্রসারিত করে, এমন কিছু আছে? না, নেই। অথচ আমরা যারা বিদেশে থাকি, তারা তো জানি এসব দেশে শিশুদের জন্য কত সুন্দর সুন্দর ছবিওয়ালা গল্পের বই আছে। রাইম আছে। যাকে বলা হয়, ‘বেড টাইম স্টোরিজ”। আমাদের দেশে এরকম বই নেই কেন? আগে তো ছিল। আমাদের শিশুদের মনোজগৎ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা দরকার না? তাদের মানসিক বিকাশের জন্য যে ধরনের উপাদান প্রয়োজন, তা কি আমাদের আছে? না, নেই।
শিশুদের জন্য বই হতে হয় সুন্দর সুন্দর ছবি সম্বলিত। শিশুদের বইতে দারুণ দারুণ ছবির মাধ্যমে গল্প এবং ছড়া বলতে হবে। বইগুলোতে যত না লেখা থাকবে, তার চেয়ে বেশি ছবি থাকতে হবে। কারণ একটি ছবি হাজার শব্দের চেয়ে বেশি কথা বলতে পারে। তাছাড়া যে শিশুটির বয়স মাত্র এক/দুই বছর, সে তো পড়তে পারে না। কিন্তু ছবি দেখে আনন্দ পায়। আমরা লক্ষ্য করেছি, এই বয়সের শিশুরা বড়দের বইয়ের ছবিওয়ালা পৃষ্ঠাগুলোতে কলম দিয়ে আঁকাআঁকি করে। তাকে নিষেধ করলে, কান্না করে। কিংবা সেই পৃষ্ঠাটি ছিড়ে নিতে চায়। সুতরাং তাদের জন্য বই হতে হবে ছবিতে ছবিতে ভরপুর। ছবিতে ছবিতে গল্প বলা, সংখ্যা শেখানোর ব্যবস্থা ইত্যাদি।
এমন বই তৈরি করার জন্য প্রয়োজন একদল গুণী মানুষ। বাংলাদেশে কি এমন একদল গুণী মানুষ নাই? অবশ্যই আছে। তারা সত্যি সত্যিই শিশুদের নিয়ে ভাবছেন। ইকরিমিকরি বুক স্টুডিও নামক একটি প্রকাশনা বাজারে এসেছে। তাদের বইয়ের জন্য ছবি এঁকেছেন-ধ্রুব এষ, চিন্ময় দেবর্ষি, জুলকারনাইন আসজাদী, তন্ময় হাসান, এবিএম সালাউদ্দিন শুভ, মাহবুবুল হক, সব্যসাচী মিস্ত্রী, নাজমুল আলম মাসুম, সারা টিউন, বিপ্লব চক্রবর্তী, শেখ ফারহানা টুম্পা, শামীম আহমেদ।
আর যারা লিখেছেন তারাও সুপরিচিত স্বনামধন্য মানুষ; যেমন তুষার আব্দুল্লাহ, সানজিদা সামরিন, কাকলী প্রধান, বিনয় বর্মন, মানব গোলদার, ধ্রব এষ, ফারজানা তান্নী, আহমেদ রিয়াজ, মাহবুবুল হক এবং আরো অনেকে। আপনিও হতে পারেন আমাদের একজন লেখক। কিন্তু কিভাবে? বলছি, অপেক্ষা করুন।
এবার সিডনি’র একুশে বইমেলা নিয়ে দুই একটি পর্যবেক্ষণের কথা বলা যাক। আমি নিজে এ বইমেলার আয়োজক সংগঠন ‘একুশে একাডেমি, অস্ট্রেলিয়া’র একজন। কিন্তু তারপরেও যা সত্য তা বলতেই হচ্ছে। আমরা দেড় যুগের বেশি সময় ধরে সিডনিতে বইমেলা আয়োজন করছি, দিনে দিনে বইয়ের দোকানের সংখ্যা এবং বই বিক্রি বেড়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সিডনি’র একুশে বইমেলায় শিশুদের জন্য তেমন কোনো বাংলা বই বিক্রি হতে দেখিনি। কারণ কি? এখানে কি শিশুরা আসে না? প্রচুর সংখ্যক শিশুরা আসে। অথচ তাদের কথা কেউ ভাবছে না কেন?
সিডনিতে কয়েকটি বাংলা স্কুল আছে। ছাত্র-ছাত্রী’র অভাবে স্কুলগুলো চালানো বেশ কঠিন হচ্ছে বলেই জানি। অথচ কতো সভা-সমাবেশে বাংলা নিয়ে কতো কথা শুনি! আমরা প্রায় সবাই উদ্বিগ্ন, প্রবাসে আমাদের শিশুরা ঠিকমতো বাংলায় কথা বলতে পারছে না। আবার অন্যদিকে তাদেরকে বাংলা ভাষাটা শিখাচ্ছিও না। তাহলে উপায়? কোনো উপায় নেই। আমাদের শিশুদের শুরুতেই বাংলা ভাষার ছড়া, গল্প, কবিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের সংযোগ ঘটাতে হবে। এটা আমাদের জাতিসত্ত্বার জন্য প্রয়োজন। হতে পারে এখনো শিশুদের জন্য বাংলা ভাষায় ভালো বইয়ের অভাব। তবুও শিশুদের জন্য বই কিনুন। আপনার শিশুর জন্য ইকরিমিকরি বেশ কিছু বই নিয়ে এসেছে, আশা করি আরো আনবো।
এমন অবস্থা থাকবে না। একদল গুণী ছেলে-মেয়ে শিশুদের জন্য কাজ করছে, আপনিও যোগ দিন। আপনি তো আপনার শিশুকে প্রতিদিন কত কত গল্প বলে খাওয়াচ্ছেন, ঘুম পাড়াচ্ছেন; সেগুলোই লিখে পাঠান। আপনার গল্পের/ছড়ার জন্য ছবি আঁকার শিল্পী আছে। ভেবে দেখুন, শিশুরা কোনো খ্যাতিমান পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের নাম দেখে বই পছন্দ করে না। তাদের কাছে ছড়া, গল্প কিংবা ছবিটা ভালো লাগলেই সে নেওয়ার/পাওয়ার জন্য কান্না শুরু করে দেয়। সুতরাং আপনিও হতে পারেন, একজন লেখক, ছড়াকার কিংবা অনুবাদক। এভাবেই আমরা সবাই ঋদ্ধ হবো, শিশুদের হাত ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবো এবং বড় হবো তাদের সঙ্গেই।
লেখা পাঠাবার ইমেইলঃ ikrimikrimail@gamil.com
বাংলাদেশ সময়: ০৮২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৭
জেডএস


