ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

মেলায় ভাষাভিত্তিক বইয়ের প্রকাশ কম, আছে নানা অন্তরায়

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২০
মেলায় ভাষাভিত্তিক বইয়ের প্রকাশ কম, আছে নানা অন্তরায়

বইমেলা থেকে: দেশে দেশে বইমেলা হয় বটে তবে আমাদের বইমেলা হয় পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। শুধু বই কেনা-বেচার উপলক্ষ নয়, এ মেলা আমাদের ভাষা আন্দোলনের চেতনা, স্বাধীনতার চেতনার বহিপ্রকাশ। 

শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ছুটির দিন হওয়ার কারণে শুরু থেকেই মেলায় ভিড়টা একটু বেশি। শহীদ মিনারে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানিয়ে লাইন ধরে মেলায় ঢুকেছে মানুষ।

 

মাতৃভাষা দিবস ঘিরে অনেকেই বইয়ের স্টলগুলোতে খোঁজ করছেন ভাষা, ভাষা আন্দোলন, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বিষয়ক বই। কিন্তু মানুষের চাহিদা অনুসারে সে রকম মানসম্পন্ন বইয়ের যোগান নেহায়েতই অনেক কম। এবার এ ধরনের বই প্রকাশ পেয়েছে আরও কম।  

এবারের মেলার প্রথম ২০ দিনে প্রায় তিন হাজার নতুন বই প্রকাশ পেলেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই ৫০টি বইয়েরও খোঁজ মেলেনি। যে কয়েকটি বই চোখে পড়ল, তার বেশিরভাগই আগে প্রকাশিত প্রবীণ লেখকদের বই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, ভাষা আন্দোলন নিয়ে নতুন লেখকদের আগ্রহ কম।  

প্রকাশকরা জানান, তারা ভাষা আন্দোলন নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য পাণ্ডুলিপি পান না। মাসব্যাপী গ্রন্থমেলার অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো অমর একুশের স্মরণ। অন্যসব বইয়ের ভিড়ে ভাষা আন্দোলনের বই রাখতেও আগ্রহী তারা। কিন্তু নতুন লেখকদের মাঝে এ ধরনের লেখালেখির আগ্রহ কম। যদিও ভাষাসংগ্রামীদের কেউ কেউ এ বিষয়ে অবিরত লিখে চলেছেন।

এ বিষয়ে আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি বাংলানিউজকে বলেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না। নতুন লেখকরা গল্প-উপন্যাস, কবিতাগ্রন্থ এমনকি সায়েন্স ফিকশনও লেখেন, কিন্তু ভাষা আন্দোলন নিয়ে এক ধরনের অনাগ্রহ দেখা যায়। অবশ্য ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার মতো যথেষ্ট মেধা ও যোগ্যতার বিষয়ও এখানে জড়িত। সে কারণে হয়তো অনেকে বিষয়টি নিয়ে ভাবেন না। তবে বইমেলা যেহেতু একুশের চেতনায়, সেহেতু অন্য সব বইয়ের মাঝে ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক বইকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে এবং আমরাও সেটি চেষ্টা করি।

ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের প্রকাশক জহিরুল আবেদীন জুয়েল বলেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে কাজ কম হচ্ছে এটা ঠিক, তবে একেবারে যে হচ্ছে না, এটাও বলা যাবে না। অনেকেই এই জায়গাটা নিয়ে হুট করে কাজ করতে পারবেন না। সেদিক থেকে পুরনো যারা আছেন, তারা লিখছেন, সাথে নতুন লেখকরাও গবেষণার মধ্য দিয়ে লিখে চলছেন। এক্ষেত্রে গবেষণাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া সাহিত্যিকরা ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে গল্প, উপন্যাসও লিখতে পারেন। আমি বলবো, ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকরা আগ্রহী, বলা যায় একটু বেশিই আগ্রহী।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণাধর্মী বই প্রকাশে আগ্রহের কথা জানিয়ে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থার সভাপতি ফরিদ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা সবসময়ই চাই ভাষা আন্দোলন বিষয়ক বই প্রকাশ করতে। তবে মানসম্মত পাণ্ডুলিপি না পাওয়ার কারণে এ ধরনের বই প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস, গল্প লেখা হলেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে তেমনটা দেখা যায় না। আমাদের দেশে হাতে গোনা কয়েকজনই মূলত ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করেন, লেখালেখি করেন। নতুনরাও আসছেন, তাদের কাজও অনেক দারুণ। তবে এই বিষয়ে অনেক গবেষণা হওয়া উচিত।

এদিকে নির্মোহ গবেষণার অভাব ও অনেকটা বাধ্য হয়ে পুরনো বইয়ের ওপর নির্ভরতাই ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখালেখির প্রধান অন্তরায় বলে মনে করছেন এ অঙ্গনের নতুন লেখকরা।  

এ প্রসঙ্গে এক তরুণ লেখক বাংলানিউজকে বলেন, ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী বর্তমানে খুবই কম। আমাদের এখন আগেকার লেখা বইয়ের ওপরই বেশি নির্ভর করা লাগে। ফলে নতুন তথ্য খুব কমই পাওয়া যায়। কাজের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় অন্তরায়। এছাড়া আরও একটি সমস্যা হলো আমাদের এখানে নির্মোহভাবে কোনো গবেষণা করা হয় না। তথ্য যেটুকুই পাওয়া যাক না কেন, গবেষণা আরো বৃদ্ধি পেলে কাজের আঙ্গিকও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করি।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে নতুন লেখকদের কাজকে সাধুবাদ জানানোর পাশাপাশি এ ধরনের কাজে আরও যত্নবান হওয়ার পরামর্শ বিশিষ্টজনদের।  

এ প্রসঙ্গে  ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেকেই কাজ করছেন, এটাকে সাধুবাদ জানাই। তবে নতুনদের কারও কারও বইয়ে তথ্যগত কিছু ভ্রান্তি পাওয়া যাচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের মতো সংবেদনশীল একটি বিষয়ে লেখার আগে শুধু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করলেই হবে না, সেগুলো সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে তারপর লিখতে হবে। ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে বেশিরভাগই যেহেতু এখন আর জীবিত নেই, সেহেতু যারা এখনও বেঁচে আছেন তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তথ্য মিলিয়ে দেখতে হবে।

'কোনদিন, কোথায়, কী ঘটেছিল সেই বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পরই লেখা উচিত। ভাষা আন্দোলনের যে তৃতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু করো’, এই বিষয়টি নিয়ে লেখা, আলোচনায় কোথাও সেভাবে আসছে না। কিন্তু এই প্রসঙ্গ নানাভাবে উঠে আসা উচিত। ’

শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) মেলায় বিভিন্ন প্যাভিলিয়ন ও স্টল ঘুরে ভাষা আন্দোলন বিষয়ক বেশকিছু নতুন বইয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে আগামী প্রকাশনী এনেছে ড. এম আবদুল আলীমের 'ভাষাসংগ্রামী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌', ড. সালিম সাবরিনের 'ভাষা সাম্রাজ্যবাদ ও মানবাধিকার', কথাপ্রকাশ এনেছে ড. এম আবদুল আলীমের 'ভাষা-আন্দোলন-কোষ' এবং 'ভাষাসংগ্রামী এম এ ওয়াদুদ', আলোঘর প্রকাশনা এনেছে আহমদ রফিকের 'বিচিত্র একুশে বিচিত্র তার চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য', অনন্যা থেকে সাহিদা বেগমের 'ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিলপত্র', হারুনুর রশিদ ভুঁইয়ার কাব্যগ্রন্থ 'অমর একুশের কবিতা', নালন্দা থেকে সোহেল মল্লিক সম্পাদিত 'ভাষা আন্দোলনের নির্বাচিত ৫০ কিশোর গল্প', সাহস পাবলিকেশন্স প্রকাশ করেছে শহিদুজ্জামানের 'সমাজ ভাষাবিজ্ঞান', ড. আনু মাহমুদের 'ভাষা আন্দোলনের ইতিকথা' এনেছে আলেয়া বুক ডিপো।

এছাড়া ময়ূরপঙ্খি থেকে রফিকুল ইসলামের 'আমার ভাষা'; বিশ্বসাহিত্য ভবনে প্রকাশ হয়েছে সাংবাদিক তারিকুল ইসলাম মাসুমের বই 'একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২', শিরীন পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে মোহাম্মদ শওকত হোসেনের কাব্যগ্রন্থ কবিতা 'একুশে দেখেছি', উৎস প্রকাশনী বের করেছে 'ভাষা আন্দোলনে হবিগঞ্জ', বিজয় প্রকাশ এনেছে আশরাফুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ 'একুশে প্রভাত', বর্ণক প্রকাশনী থেকে রীনা আহমেদের গল্পগ্রন্থ 'বাংলার প্রহরী ২১ ফেব্রুয়ারি', রিয়া প্রকাশনী এনেছে মাইনুল ইসলাম মাস্টারের প্রবন্ধগ্রন্থ 'একুশের অবদান'।

আরও পড়ুন>>> কথার ঝুড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরার দিন আজ

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২০
এইচএমএস/এইচজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।