ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

সমুদ্রই দেয় দুর্যোগের সংকেত

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩১ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৪
সমুদ্রই দেয় দুর্যোগের সংকেত

চরআন্ডা, চরমোন্তাজ, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী থেকে: উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ংকরী সিডরের সময় একটিমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ সাইক্লোন শেলটার ছিল এখানে। জীবন বাঁচাতে সেটিতেই আশ্রয় নিতে হয় হাজারো মানুষকে।

প্রায় ছয় বছর পর ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের তাণ্ডব থেকে বাঁচতে ওই ঝূঁকিপূর্ণ শেলটারই ছিল এখানকার মানুষের ভরসা। বিপন্ন মানুষের আশ্রয় মেলে বাঁধের ওপর। সে বাঁধও এখন ঝুঁকির মুখে।

সরেজমিন তথ্য সংগ্রহে গেলে সমুদ্র মোহনার প্রতিনিয়ত দুর্যোগের শংকায় জেগে থাকা দ্বীপ চরআন্ডার খেয়াঘাট এলাকার বাসিন্দা সাহিদা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, আল্লায় বাঁচাই রাহে দেইখ্যা মোরা বাঁইচা আছি। সাগরের একটা ঢেউতে মোগো পঞ্চাশ ফুট দূরে লইয়া যায়। মোগো দিকে তো সরকার ফিরে চায় না।

এমন কথা আরও অনেকের। চরমোন্তাজ থেকে খেয়া পার হয়ে চরআন্ডায় উঠতেই একটা ছোট্ট দোকানের সামনে ভিড় জমানো নারী-পুরুষের কণ্ঠে নানা অভিযোগ। তারা জানালেন, এখানে একটিমাত্র সাইক্লোন শেলটার আছে। সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রচণ্ড বাতাসে এটি কেঁপে ওঠে। জীবন বাঁচাতে এখানকার মানুষজন তখন ছুটাছুটি করে। নিরুপায় হয়ে আশ্রয় নেয় ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধে।

এলাকাবাসী চরের চারিদিকে শক্ত করে একটা বেড়িবাঁধ চান। চার হাজার মানুষের জন্য অন্তত দুটো সাইক্লোন শেলটার আর তিনটি উঁচু মাটির কেল্লা চান। এখানকার বাড়িগুলো পাকা করে দেয়ার দাবিও রয়েছে তাদের।

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজের অধীনে আরেকটি দ্বীপ চরআন্ডা। ইউনিয়নের নয় নম্বর ওয়ার্ড এটি। পুরানো কাগজপত্রে কোথাও এই দ্বীপের নাম চর প্রসন্ন আবার কোথাও চর প্রকাশ উল্লেখ থাকলেও এটি এখন চরআন্ডা নামেই পরিচিত। এখানে লোকসংখ্যা রয়েছে প্রায় চার হাজার।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দুবছর আগে চরটির চারিদিকে বেড়িবাঁধ দেয়া হলেও পূর্বাংশে সমুদ্রের নিকটবর্তী এলাকায় প্রায় চার কিলোমিটার বাঁধ ধসে গেছে। বালুর বাঁধ মিশে গেছে বালুর সঙ্গে। এলাকাবাসীর অভিযোগ বাঁধ নির্মাণের সময় একে টেকসই করার কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলেই এ অবস্থা হয়েছে। ফলে দ্বীপের বাসিন্দাদের রক্ষায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও তা কোনো কাজে আসেনি।

চরআন্ডার সাগর বাজারটির অবস্থান একেবারেই সাগরের তীরে। এখান থেকে সাগরের দূরত্ব এক কিলোমিটারের কম। এলাকার ঝুঁকি নিয়ে এখানকার মানুষের সঙ্গে আলাপকালে জেলে দীপু মোল্লা জানালেন, এই সাগরই আমাদের বাঁচায়, আবার এই সাগরই ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ঝড়ের খবর পেতে রেডিও টেলিভিশন লাগে না, এখানকার মানুষ সিগন্যাল পায় সাগরের কাছে।

চরআন্ডার নিরাপত্তা প্রসঙ্গে আলাপ করতে গেলে সাগর বাজারের বাসিন্দারা বলেন, এখানকার মানুষজন চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও তাদের নিরাপত্তায় নেওয়া হয় না বিশেষ কোনো ব্যবস্থা। ঘূর্ণিঝড় সিডরে এখানে প্রলয় ঘটেছে। তাৎক্ষণিক কিছু সাহায্যও এসেছে। কিন্তু মানুষের জীবন বাঁচাতে টেকসই কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাঁধ হওয়ার আগে জোয়ারের পানি ভাটায় নেমে যেত। এখন জোয়ারে পানি ওঠে ঠিকই, কিন্তু তা সরতে পারে না। মানুষজন দিনের পর দিন পানিবন্দি হয়ে পড়ে।

এলাকার ওয়ার্ড মেম্বার মহিউদ্দিন বাচ্চু এলাকা ঘুরিয়ে সমস্যার চিত্র দেখাচ্ছিলেন। সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে যেতে যেতে দেখান বাঁধের বিপন্নতা। সমুদ্র ফুঁসে উঠলে পানিতে ডুবে যায় বাড়িঘর। দ্বীপে খাবার পানির অভাব, দুর্যোগে আশ্রয় নেওয়ার স্থানের অভাব, শিক্ষা আর স্বাস্থ্য সংকটের কথাও জানান তিনি। এলাকার মেম্বারের কণ্ঠে সুর মেলান স্থানীয় বাসিন্দারা।

সাগর বাজারে দোকানের সামনে ভিড় করে আছে কয়েকজন কিশোর। মো. লাদেন, মোক্তার হোসেন, মো. সাগর, মো. আদিপাসহ আরও কয়েকজন। কারও বয়স ১০, কারওবা ১২ বছর। ভর দুপুরে ওরা স্কুল থেকে আসেনি, কেবলমাত্র কাজ শেষে মাছধরা নৌকা থেকে এসেছে। কেউ হয়তো ওয়ান-টু পর্যন্ত পড়েছে। কেউ পার হয়নি স্কুলের চৌকাঠ। বাবার পেশার সূত্র ধরে মাছধরা ছাড়া ওদের কোনো গতি নেই। বাহির জগতের কোনো স্বপ্ন ওরা দেখার সুযোগ পায় না।

এই কিশোরদের সঙ্গে আলাপের সময় পাশে থাকা অভিভাবক রফিক মাঝি বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করে বলেন, ছেলেমেয়েদের থ্রি-ফোর পর্যন্ত লেখাপড়া করানো তো ভাগ্যের ব্যাপার। এখানে একটিমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। অতিকষ্টে প্রাথমিক শেষ করতে পারলে মাধ্যমিকের জন্য নদী পেরিয়ে চরমোন্তাজে যেতে হয়। খরচ বাড়ে টাকা-পয়সা খরচ করে অনেকেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারে না।

চরআন্ডার জেলেদের এখন অভাবের কাল। মাছের মৌসুম ফিরতে আরও কিছু সময় বাকি। তাই সমুদ্রপাড়ের এই সাগর বাজারটি নিস্প্রাণ পড়ে আছে। দোকানপাটে নেই বেচাকেনা। জেলেদের হাতে নেই কাজ। তারা প্রস্তুত হচ্ছে মৌসুমের জন্য। জেলেরা এই সময়টিকে অকাল হিসাবেই তুলে ধরলেন। কারণ এই সময়ে তাদের ধারদেনা করে সংসার চালাতে হয়।

প্রতিনিয়ত সংকটের ভেতর দিয়ে সময় পার করে সমুদ্র মোহনার দ্বীপ চরআন্ডা। এখানকার মানুষজনের অভাব-অভিযোগের শেষ নেই। তাদের দাবি নিরাপদে বেঁচে থাকা। কিন্তু ঝুঁকি যেন কিছুতেই শেষ হতে চায় না।

বাংলাদেশ সময়: ০২৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।