হরিশপুর, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম ঘুরে এসে: সবুজে ঘেরা উপকূলের প্রাকৃতিক দেয়াল আর থাকছে না। এক সময়ের গাছপালা আর সবুজে ঢাকা এলাকা এখন বিরান হয়ে পড়ছে।
ঐতিহ্যবাহী দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের পশ্চিমে রহমতপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকা সরেজমিন ঘুরে নদী তীরে বহু গাছপালা মরে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। এর ফলে নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের জীবনের ঝুঁকি অনেকে বেড়ে চলেছে। বনাঞ্চল ছিল বলে এই এলাকার মানুষ আগে ঘূর্ণিঝড়কে ততটা ভয় পেতো না। কারণ এটাকে তারা নিরাপত্তা দেয়াল হিসাবে মনে করতেন।
সন্দ্বীপের হরিশপুর, রহমতপুর, বাংলাবাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাঁধ ভাঙছে, বিলীন হচ্ছে জনপদ। সঙ্গে সঙ্গে মানুষগুলো ছুঁটছে নিরাপদ স্থানে। বহু মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।
বাঁধের পাশের বাসিন্দারা জানান, এই এলাকায় ১০-১৫ বছরে কতবার যে বাঁধ বানানো হয়েছে, তার হিসেব নেই। ভাঙন এগিয়ে আসার সঙ্গে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বাঁধ।
স্থানীয়রা জানালেন, ভাঙনে জনপদ বিলীন হওয়া আর বার বার ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে বহু গাছপালা মরছে। তারা জানান, এই এলাকায় তাল, খেঁজুর, নারিকেল, তেঁতুলসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ মরে যাচ্ছে। রহমতপুরে বাঁধের বাইরে বহু গাছ মরে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। গত বছর বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের তাণ্ডবে লবণ পানির প্রভাবে গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজনের দাবি।
রহমতপুর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডে বাঁধের কিনারে বসবাসকারী এলাকার বাসিন্দা মফিজ উদ্দিন মরা গাছের দিকে আঙুল তুলে বলছিলেন, এক সময় এই নদীর তীরে অনেক গাছপালা ছিল। তখন এই এলাকার মানুষদের ঝড়ের ভয় কম ছিল। কিন্তু প্রতিবছর বহু গাছপালা মরে যাওয়ায় ঝড়ের ঝুঁকি বাড়ছে। নদী-ভাঙন আর লবণ পানিতে বেশিরভাগ গাছ মরে যাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এই এলাকায় বাঁধের বাইরের অনেক এলাকায় শুকনো মৌসুমে লবণ পানি ওঠে। এরফলে জমিতে কোনো ফসল ফলানো যাচ্ছে না, অন্যদিকে গাছও মরে যাচ্ছে। পাশেই সারি সারি মরে যাওয়া গাছপালা চোখে পড়ে। যে গাছে পাখি বাসা বাঁধতো, সে গাছের মাথা শুকিয়ে পাতা ঝরে পড়ছে। কোথাও শুকনো গাছ মাটিতে শুয়ে পড়েছে।
সন্দ্বীপের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় সারিকাইত ইউনিয়নের বাংলাবাজার। বাঁধের পাশে ছোট্ট চায়ের দোকানে আলাপ হচ্ছিল গুণধর জলদাসসহ আরও কয়েকজন স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। তারা জানালেন, এই এলাকায় সবুজ বনায়ন ছিল। চারিদিকে ছিল অনেক গাছপালা। তখন এলাকার মানুষ ঝড়ের ততটা ভয় করতো না। এখন তো গাছপালা নেই। বড় ঝড় না হলেও বাতাসের ঝাপটাটা অনেক বেশি লাগে।
বাংলাবাজারে কথা বলার সময় বেশ কয়েকজন বয়সী ব্যক্তি জানান, এ এলাকা থেকে সমুদ্র অনেক দূরে ছিল। নদীর কিনার পর্যন্ত হেঁটে যেতে অনেক সময় লাগতো। এখন তো আমরা নদীর কিনারে। ভাঙন এসেছে বাড়ির কাছে। এখান থেকে ঘরবাড়ি নিয়ে কবে সরতে হতে ঠিক নাই। গাছপালা না থাকায় আমরা সারাক্ষণ ভয়ে থাকি।
হরিশপুরের তালুকদার মার্কেট ছিল সন্দ্বীপের সবচেয়ে বড় বাজার। এই বাজারের চারপাশে ছিল ঘর বন। সেগুলো এখন আর নেই। বাজারে অবশিষ্ট রয়েছে মনিরুজ্জামানের চায়ের দোকানটি। হয়তো এ দোকানটিও এক সময় থাকবে না। এখানে এলাকাবাসী জানাচ্ছিলেন, সন্দ্বীপের প্রাণকেন্দ্র এই তালুকদার মার্কেটের যে এ অবস্থা হবে, সেটা কেউ কোনদিন কল্পনাও করেনি। এখন সেটা আমরা দেখছি।
তারা জানান, এই মার্কেটের পাশে সেদিনও অনেক গাছপালা দেখেছি। কিন্তু এখন নেই। প্রত্যেক বার ঝড়ের সময় কিছু গাছপালা মারা যায়, আর কিছু গাছ দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষতির মুখে পড়ে। এরফলে এ এলাকার মানুষগুলো দিনে দিনে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে।
সন্দ্বীপ বন বিভাগ সূত্র বলছে, ভাঙন ও লবণাক্ততার কারণে সন্দ্বীপের অনেক স্থানে গাছপালা মরছে। তবে নতুন চরে বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সন্দ্বীপের পূর্বদিকে গুপ্তছড়াসহ আশপাশের এলাকায় ব্যাপক বনায়ন করা হয়েছে। এই বনায়ন বেড়ে উঠলে এখানে আবারও সবুজ নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে উঠবে।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৬ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১৪