সন্দ্বীপ ঘুরে এসে: জলবায়ু পরিবর্তন আর মানবসৃষ্ট বিপর্যয়, দু’য়ে মিলে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। প্রবল জোয়ারে সমুদ্রের লবণ পানির গ্রাসে ফসলি মাঠ হারাচ্ছে উর্বরতা, ফসলের বৈচিত্র্য বদলে যাচ্ছে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাট থেকে সাগড় পাড়ি দিয়ে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়ায় পৌঁছুলে যে কারও ধারণা হবে, এই এলাকার ওপর দিয়ে অল্প ক’দিন আগে ঝড় বয়ে গেছে। গাছের গোড়া মরে যাচ্ছে, পাতা ঝরে যাচ্ছে, ফসলি মাঠে জমেছে লবণের আস্তরণ, বনের সবুজ ছায়া কমে যাচ্ছে। বনের পাশে ইটের ভাটার কালো ধোঁয়া আকাশে ছড়িয়ে এ অবস্থাকে যেন আরও বিপন্ন করে তুলছে।
আবার সন্দ্বীপের পশ্চিমে এসে মেঘনা তীরে দাঁড়ালে আরেক দৃশ্যপট। লবণ পানির ঝাপটায় গবাদি পশুর ঘাস খেয়ে বাঁচার সুযোগটাও শেষ হয়ে গেছে। বহু পতিত জমিতে চাষিরা আবাদ ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। ফসল হচ্ছে না, তাই চাষাবাদ বন্ধ বলে জানালেন স্থানীয় চাষিরা। যেসব চাষি এই জমিতে আবাদ করে বছরের চাল-ডাল মজুদ করতেন, তারা এখন জীবিকার পথ খুঁজছেন অন্য পেশায়।
ভর দুপুরে তপ্ত রোদের মাঝে মেঘনা তীরের হরিশপুর এলাকায় লবণ মাটির উপর দিয়ে হেঁটে আসছিলেন এককালের চাষি আবুল কালাম, সাইদুর রহমান ও আলতাফ হোসেন। মাছধরা ট্রলার থেকে দ্রুত পায়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন তারা। দুপুরের খাবার শেষে আবার ফিরতে হবে ট্রলারে। হাঁটার গতি থামিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ। জানালেন, এই জমিতে আবাদ করেই এই এলাকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতো। ধানসহ বহু ফসল হতো। চাল-ডাল-শাকসবজি বাইরে থেকে কিনতে হতো না। এখন সে অবস্থা নেই।
হরিশপুরের বাসিন্দারা জানালেন, নদীভাঙন আর লবণ পানিতে লন্ডভন্ড হওয়ায় এই এলাকার বহু চাষি পেশা ছেড়ে দিয়েছে। কেউ অন্যের নৌকায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে, কেউ দিনমজুর, আবার কেউ কাজের খোঁজে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। হরিশপুরের কাছে রহমতপুর স্টিমার ঘাটে যে একদল দিনমজুরের সঙ্গে কথা হলো, এরা সবাই ছিল চাষি। সব হারানো এই মানুষের দল অবশেষে এই পেশায় আসতে বাধ্য হয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী ইলিশের বাজার বলে খ্যাত সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নের বাংলাবাজারের পুরো পরিবেশটাই বদলে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বহু জেলে চাষি পেশা বদল করে অন্য পেশা বেছে নিয়েছে। সমুদ্রের জোয়ারের পানি আগের চেয়ে একটু উঁচুতে এসে আঘাত করছে। ফলে বসত ঘর বানাতে হচ্ছে উঁচু করে। যে ফসলি জমিতে আগে লবণ পানি জমে থাকতো না, সেখানে পানি জমার কারণে লবণের আস্তরণ স্পষ্ট।
সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাট থেকে কিনারে উঠলে চোখে পড়ে ফাঁকা বন। বনের ভেতর দিয়ে সড়ক, যানবাহন চলাচল। পাশে ইটভাটার ধোঁয়া বনের ওপরের আকাশ কালো করে তুলছে। স্থানীয়রা জানালেন, লাইসেন্স বিহিন এই ইটভাটা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। বন বিভাগের গুপ্তছড়া বিটের বন কর্মকর্তা আবদুস সামাদ বলেন, লাইসেন্স বিহিন ইটভাটা চালানোর বিষয়ে আমাদের কিছুই করার নেই।
তবে তার দাবি, এই ইটভাটায় বনের কাঠ পোড়ানো হয় না।
জলবায়ু পরিবর্তনে সবুজে ভরা দ্বীপগুলো এভাবেই বদলাতে থাকে, ঠিক সন্দ্বীপের মত। এর সঙ্গে মানবসৃষ্ট কারণও যুক্ত হয়। প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা মানুষগুলো বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বহুমূখী পদক্ষেপ নেয়। এরই বিরূপ প্রভাবে ক্ষতবিক্ষত হয় মানুষের জীবন। শেষ পর্যন্ত আদি বসতিতে টিকে থাকাও সম্ভব হয় না তার পক্ষে।
একই দাবি সন্দ্বীপের বিপন্ন মানুষদেরও। শক্ত করে উঁচু বাঁধ আর ব্যাপক বনায়ন। তারা মনে করেন, দ্বীপগুলো রক্ষায় বাস্তবস্মত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এরফলে উপকূল রক্ষায় কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও এর সুফল মিলছে সামান্যই।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ০২৫৭ ঘণ্টা, জুন, ৭, ২০১৪