সাকুচিয়া, মনপুরা, ভোলা থেকে: ‘ফকিরার কপাল অইছে পোড়া, আইন্না দিছে কাশের বাটি, অইয়া গ্যাছে খোরা’। আঞ্চলিক ভাষায় নিজের কষ্টের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে করতে ঘর থেকে ছুটে এলেন নূর জাহান বেগম।
শুধু নূর জাহান নয়, ভোলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মনপুরার দক্ষিণ সাকুচিয়াসহ আশপাশের গ্রামের মানুষের গল্প এমনই। এবার পূর্ণিমার জো’তে তারা সবচেয়ে বড় জোয়ারের চাপ দেখেছেন। শুধু দেখেননি, জোয়ারের পানি তাদের ঘরহারা করেছে। ঘরে পানি ওঠার পর প্রথমে চৌকিতে আশ্রয় নিয়েছেন, সেখানেও থাকা সম্ভব হয়নি বলে উঠে এসেছেন রাস্তায়।
নূর জাহানের স্বামী রহমত আলী রাঢ়ি মারা গেছেন অনেক আগে। এক পঙ্গু ছেলে দুলাল আর একজন এতিম নাতি ফারুক হোসেনকে নিয়ে থাকেন দক্ষিণ সাকুচিয়ার সরকারি আবাসনের ছোট্ট ঘরে। কাজকর্ম নেই। যাদের স্বামী আছে, তাদের কিছু রোজগার থাকলেও নূর জাহানের মত বিধবা নারীদের জীবনের সংকট যেন কাটে না।
খানিক দূরে আবাসনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বিপন্ন বাসিন্দাদের ভিড় জমে যায়। আবদুর রহমানের স্ত্রী সাজিদা বেগম, মিলন তালুকদারের স্ত্রী আকলিমা, কবির বেপারির স্ত্রী মাহিনূর, নোমান পলোয়ানের স্ত্রী বিবি ফজিলা, শাহেদ আলী হাওলাদারের স্ত্রী রোকেয়া বেগম, ইউসুফ আলী রাঢ়ির স্ত্রী বিবি হাজেরা, কামাল খা’র স্ত্রী আরজু বেগমসহ আরও অনেকের ভিড়।
আবাসনের বাসিন্দারা জানালেন, এর আগে কোন জোয়ারের পানিতে এই এলাকার বাড়িঘর ডুবেনি। ঘরে পানি ওঠেনি। কিন্তু এবার তাদের সব শেষ করে দিয়েছে। পাশের পুকুর উপচে জোয়ারের পানি উঠে এসেছে বাড়িঘরে। বন্ধ পানির চাপে ৪-৫ দিন ঘরের চুলায় রান্না করা সম্ভব হয়নি। অনেকেই দেনায় জড়িয়ে পড়েছেন। ঋণের বোঝা টেনে নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
আবাসনের লম্বা টিনশেডে ছোট ছোট খুপড়ি ঘর। এতেই বসবাস ৫-৬ জনের পরিবার। ঘরের পেছনে নিজেরাই খড় দিয়ে রান্না ঘর বানিয়ে নিয়েছে। ঘরের পেছনে ডোবানালা, সামনে বড় পুকুর। ঘরের সামনে দিয়ে সরু রাস্তা কাদাপানিতে একাকার। বর্ষা হলে ঘর থেকে বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই এদের।
সূত্র বলছে, এবার মনপুরায় পূর্ণিমার জোয়ারের পানি ঢুকেছিল ১২ জুলাই। এবারের জো’তে পানির চাপ বেশি ছিল, পানির উচ্চতা বেশি ছিল, পানি জমে থাকার সময়কালও বেশি ছিল। ফলে ভোগান্তির মাত্রা ছিল অনেক বেশি। দক্ষিণ সাকুচিয়ায় নদী তীরবর্তী নতুন বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে এই এলাকায় জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে।
শুধু বসতি নয়, জোয়ারের পানিতে কয়েকদিন ধরে পানিতে ডুবে থাকায় বহু মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। বেড়েছে দেনার বোঝা। ফলে এই পরিবারগুলোতে তিনবেলা খাবার জোটানো মুস্কিল হয়ে পড়েছে। পরিবার পরিজন নিয়ে আবাসনের মানুষের কষ্টের দিন যেন বেড়েই চলেছে। রমজানে ইফতার-সেহরিতেও এই মানুষেরা পায় না বিশেষ কোন খাবার।
আবাসনের সামনে দাঁড়াতেই দলে দলে ভিড় করে শিশুরা। কেউ খেলাধুলা বন্ধ রেখে, কেউবা পুকুরে ডুব-সাঁতার থেকে উঠে এসে ক্যামেরার সামনে হাজির। ছবি তোলার জন্য ওরা নানান ভঙ্গিমায় ক্যামেরার সামনে দাঁড়ায়। ওদের সংখ্যা দেখে মনে হলো আবাসনের বয়স্ক মানুষের চেয়ে শিশুর সংখ্যাই যেন বেশি। এদের মধ্যে বহু কংকালসার মুখ। হয়তো নিয়মিত খাবার না পাওয়ায় শরীরে বাসা বেঁধেছে পুষ্টিহীনতা। অনেকেই পার হতে পারেনি স্কুলের চৌকাঠ।
ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, বাঁধভাঙা জোয়ারের পানিতে ব্যাপক ক্ষতির পরও এলাকার মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছেনি। কিছু মানুষের ভাগ্যে রমজান ও ঈদ উপলক্ষে দেওয়া সাত কেজি করে চাল জুটেছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য প্রসঙ্গে আলাপ করতেই ক্ষোভ দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অলিউল্লাহ কাজলের। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, জোয়ারের পানিতে ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা অন্তত পাঁচ হাজার। এদের সহায়তা হিসেবে বরাদ্দ হয়েছে মাত্র আড়াই মেট্রিকটন চাল। এই চাল মাত্র দু’কেজি করে আড়াইশ’ পরিবারকে দেয়া সম্ভব হবে। সে কারণে বরাদ্দকৃত চাল উত্তোলন করেননি চেয়ারম্যান।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে।
আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৪