হাজীর হাট, মনপুরা, ভোলা থেকে: সমুদ্র মোহনায় মেঘনার তীরে প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে আছেন বহু মানুষ। বাঁধ ভেঙে যায়, আবার তৈরি হয় নতুন বাঁধ।
দ্বীপ মনপুরার সর্বদক্ষিণে দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের মেঘনার তীর ঘেঁষা গ্রামগুলোর মানুষের অবস্থা এমনই। বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগে লন্ডভন্ড হওয়ার জীবনের নেই কোনো স্থিতিশীলতা। তিনবেলা খাবার সংগ্রহ করতে না পারার কষ্ট, স্বস্তিতে বসবাস করতে না পারার কষ্ট, কর্মহীন দিন কাটানোর কষ্ট বিপর্যস্ত করে তোলে এদের জীবন। কাজ ও খাদ্যের অভাবে এখান থেকে বহু মানুষ ছুটে যায় শহরে।
মনপুরা উপজেলার সর্বদক্ষিণে দক্ষিণ সাকুচিয়া সরেজমিনে ঘুরে এসব তথ্য পেয়েছে বাংলানিউজ। এলাকায় ঢুকে ছবি তুলতে গেলেই মানুষের ক্ষোভ। কত ছবি তোলা হয়, কত তথ্য নেওয়া হয়; কিন্তু এদের অবস্থা বদলায় না। স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন এলাকার জনপ্রতিনিধিদের ওপর। নির্বাচন এলে তারা ভোট দিলেও ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান কিংবা এমপি তাদের খোঁজ নিতে আসেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাসিন্দারা জানাচ্ছিলেন, ক’দিন আগে পূর্ণিমার জোয়ারে ক্ষতির পর কোনো সাহায্য মেলেনি তাদের। অথচ বাঁধ ভেঙে আসা পানি তাদের বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েকদিন ধরে বাঁধের ওপর ঝুপড়ি বানিয়ে থাকতে হয়েছে তাদের। একদিকে নদীতে মাছের দেখা নেই, অন্যদিকে নেই বিকল্প কাজের ব্যবস্থা। ফলে দুর্যোগের দিনে মানুষগুলোর জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।
দক্ষিণ সাকুচিয়া বাঁধের ধারে দেখা ছলেমান মিয়ার স্ত্রী বিবি পিয়ারা, নাগর পাটোয়ারীর স্ত্রী বিবি গোলাপজানের সঙ্গে।
এদের সঙ্গে কথা বলার সময় ভিড় জমে আরও কয়েকজনের। জাফর হোসেন, রশিদ মাঝি, নূরনবীসহ অনেকেই জানালেন তাদের কষ্টের দিন যাপনের কথা। জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর ভেসে যাওয়ার পর মেঘনা পাড়ের এই মানুষেরা ধারদেনা করে দিন অতিবাহিত করেছেন। ক’দিন ধরে চুলোয় হাঁড়ি ওঠেনি। দোকান থেকে রুটি-কলা-মুড়ি-চিড়া এনে ক্ষুধা নিবারণ করেছেন।
জোয়ারের পানিতে ভাসা গ্রামের মানুষেরা বহু কষ্টে দিনগুলো অতিবাহিত করছেন। খেয়ে না খেয়ে কেটেছে রমজান, বহু পরিবারে এবারের ঈদের আনন্দও ম্লান। রমজানের শেষদিকে এসে মুড়ি-ছোলা দিয়ে ইফতারি হবে বলে বিবি পিয়ারার মুখে ফুটে ওঠে আনন্দের ঝিলিক। কারণ এর চেয়ে ভালো ইফতারি জোটে না তাদের। যাদের সঙ্গে আলাপ হলো, কারও ঘরেই নেই ঈদের প্রস্তুতি।
ভর দুপুরে বাঁধের তীর ধরে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল বহু নারী অপেক্ষা করছেন বাড়ির সামনে। এটা হচ্ছে দুপুরের রান্নার আয়োজনের জন্য অপেক্ষা। স্বামী কখন ফিরবে চাল-ডাল নিয়ে, সেজন্যে অপেক্ষা। এই এলাকার বহু পরিবার দৈনিক রোজগারের উপর নির্ভরশীল। রোজগার না থাকলে চলতে হয় ধারদেনা করে।
দক্ষিণ সাকুচিয়ায় চোখে পড়লো জোয়ারের পানিতে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা হচ্ছে। এই বাঁধ ভেঙেই উত্তর ও দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছিলো। দক্ষিণ তালতলা থেকে হাজীরহাট যাওয়ার রাস্তার আট কিলোমিটার ডুবে গিয়েছিল তিন ফুট পানির নিচে। পূর্ণিমায় জোয়ারের পানির এত বেশি চাপ এলাকার মানুষ এর আগে কখনো দেখেননি।
এতটা ঝুঁকিতে থাকা এই এলাকার মানুষেরা জোড়াতালির বাঁধ চান না। আলাপ প্রসঙ্গে তারা বলছিলেন, ভেঙে যাওয়ার পর যে বাঁধ তৈরি হচ্ছে তা তো আবারও ভেঙে যাবে। সামনেই আরেকটি জোয়ারের সম্ভাবনা আছে। এতে পানির চাপ বেশি হলে আবারও ডুববে বাড়িঘর। এজন্য এলাকার মানুষের দাবি একটা শক্ত উঁচু বাঁধ।
ঠিকাদারের পক্ষে বাঁধের কাজ তদারককারী স্থানীয় ব্যক্তি মো. আলমগীর মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, জোয়ারে ভেঙে যাওয়ার পর এই বাঁধ নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। লবণ পানিতে যাতে বাঁধ ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য বাঁধের বাইরের অংশে জিও ব্যাগ দেয়া হয়েছে।
তবে ভেঙে যাওয়া বাঁধ পুরোটা এবারের বর্ষায় পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। এরফলে জোয়ারের পানির আতংকে রয়েছেন এলাকার বহু মানুষ।
এলাকার মানুষের অভিযোগ প্রসঙ্গে দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অলি উল্লা কাজল বাংলানিউজকে বলেন, এলাকার মানুষের অভিযোগ থাকা স্বাভাবিক। তাদের ক্ষতির পর যথাযথভাবে সহায়তা করার মতো বরাদ্দ পাওয়া যায় না। এলাকার খোঁজখবর রাখি। তবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তো তাদের খোঁজ রাখা সম্ভব নয়।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ০০১৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৪