লালুয়া, কলাপাড়া, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: নারীর ক্ষুদ্র উদ্যোগে ঘুরছে সংসারের চাকা। পুরুষের আয়ের সঙ্গে যোগ হচ্ছে নারীর রোজগারের টাকাটাও।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় লালুয়া ইউনিয়নের চারিপাড়াসহ আশপাশের গ্রামের মানুষ এভাবেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। বছরের পর বছর যেখানে ফসল হচ্ছে না, নদীতে যেখানে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে কিছু মানুষকে বাঁচার পথ দেখাচ্ছে এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ। ইউনিয়নের অন্তত দশ গ্রামের মানুষের বিপন্নতায় ডুবে আছে। কয়েক বছর ধরে চাষি জমিতে ধান ফলালেও ধান কাটার কোন উৎসব তাদের সামনে আসে না। কারণ, ধানই হয় না।
চারিদিকে সংকটে থাকা এসব মানুষের তথ্য সংগ্রহে গিয়ে বাংলানিউজের চোখে পড়ে কিছু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। দরিদ্র-হতদরিদ্র নারীরা ছোট ছোট গ্রুপে সংগঠিত হয়েছেন। গড়ে তুলেছেন সমিতি। সাপ্তাহিক বৈঠকে বসছেন, আয়-রোজগারের পথ বের করছেন। নিজেরাই ব্যবসায় লাভ-লোকসানের হিসেব কষছেন। এরই ভিত্তিতে নিচ্ছেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঋণ। কেউ স্বামীকে জাল-নৌকা তৈরি করে দেওয়ার জন্য ঋণ নিচ্ছেন, কেউবা গাভী পালনের জন্য। আবার অনেকে ঋণের টাকায় সেলাই মেশিন, হাঁসমুরগি পালন কিংবা সবজির বাগান করার প্রকল্প নিয়েছেন।
লালুয়া ইউনিয়নের সীমানায় রামনাবাদ নদীর তীরে সবচেয়ে বিপন্ন জনপদ নয়াকাটা গ্রামে থাকেন লিপি বেগম। স্বামীর নাম হালিম হাওলাদার। বাঁধের ভেতরে ছোট্ট ঘরটা যে বার বার জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়, তার ছাপ স্পষ্ট। ঘরের চারপাশে বাঁশের বেড়াগুলো ক্ষয়ে গেছে। ঘরের মেঝে ব্যবহারের সুযোগ নেই বলে অনেক আগে থেকেই পাটাতনের ওপরেই পরিবারের সবাই থাকেন। পাটাতনে ওঠার জন্য দেওয়া কাঠের সিঁড়িটাও যেন খানিক মাটিতে বসে গেছে।
ঘরে ঢোকার আগেই সেলাই মেশিনের শব্দ। সেলাইয়ের কাজ চলছে। পড়ন্ত বিকেলে ঘরের ভেতরটা অন্ধকারে ঢেকে গেছে। সে কারণে সৌর বিদ্যুতের আলো সেলাই মেশিনের আশপাশ আলোকিত করে তুলেছে। একমনে কাজ করে চলেছেন লিপি বেগম। ঘর সামলানো, ছেলেমেয়ে লালন পালন, রান্নাবান্নার সব কাজ গুছিয়ে সেলাইয়ের কাজে বসেন এই নারী। ঘরে ঢোকার আগে দরজায় দাঁড়িয়ে লিপি বেগমের স্বামী হালিম হাওলাদার। কোন অভিযোগ নেই তার। বরং তার কথায় স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতাই ফুটে ওঠে।
আলাপ লিপি বেগমের সঙ্গে। খুব বেশি টাকা হয়তো জমাতে পারেন নি। তবে চার ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠানো, এক মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পেছনে লিপি বেগমের বাড়তি রোজগার অনেকটাই সহায়তা করেছে। স্ত্রীর রোজগার থেকে স্বামী মাছের ব্যবসার জন্য নিয়েছি দশ হাজার টাকা।
লিপি বললেন, এখন স্বামীর বাইরে কাজকর্ম না থাকলেও সংসারটা চালিয়ে নেওয়ার মত ব্যবস্থা হয়েছে। অর্ধপেট খেয়ে আর দিন পার করতে হয় না।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (কোডেক)-এর নয়াকাটা মহিলা সমিতির সদস্য লিপি বেগম। ওই সংগঠন থেকে তার সুযোগ আসে সেলাই প্রশিক্ষণ নেওয়ার। কলাপাড়া উপজেলা সদরে গিয়ে একমাসব্যাপী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। সেখানে ভাতা হিসাবে পেয়েছিলেন ৫২০০ টাকা। ওই টাকার বদলে তিনি একটি সেলাই মেশিন এনেছেন। এভাবেই তার পরিবর্তনের সূচনা ঘটে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, নারীদের সম্পৃক্ত করে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে নানান উদ্যোগ নিচ্ছে কোডেক। নয়াকাটা গ্রামের মিজানুর প্যাদার স্ত্রী রওশন আরা, মামুন মিয়ার স্ত্রী সালমা বেগম, ইউসুফ হাওলাদারের স্ত্রী রহিমা বেগম, সেলিম মিয়ার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম, মরহুম মোতালেব মিয়ার স্ত্রী রাবিয়া বেগম, আমীর আলী বয়াতির স্ত্রী জরিনা বেগমসহ আরও অনেক এগিয়ে চলা নারীর সঙ্গে দেখা হয়। এরা কোডেক সমিতির সদস্য হয়ে বিভিন্ন অংকের টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে সংসারের চাকা সচলে সহায়তা করছেন।
নয়াকাটা মহিলা সমিতির সভানেত্রী রওশন আরা বেগম নিজেও ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে জালনৌকা করেছিলেন। তবে তেমন মাছ মেলেনি। কিছু টাকা গাভী পালন ও সবজি চাষে লাগিয়েছেন। তিনি জানালেন, সমিতির সদস্যদের প্রত্যেকের অবস্থাই আগে বেশ খারাপ ছিল। তাদের সংসার চলত অতিকষ্টে। এখন সে অবস্থা বদলেছে। নগদ কিছু টাকা হাতে পেয়ে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছেন।
সূত্র বলছে, লালুয়া ইউনিয়নের নয়াকাটা গ্রামের নদীতীরবর্তী দুর্যোগ-প্রবণ এলাকায় এই মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১১ সালে। সমিতির সদস্য সংখ্যা ২৮ জন। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসফ)-এর আল্ট্রা পুওর (ইউপি) প্রকল্পের অধীনে গ্রামের অতিদরিদ্র নারীদের নিয়ে এ সমিতি গঠিত। তবে এই এলাকায় কোডেক-এর নিজস্ব অর্থায়নে রুরাল মাইক্রোক্রেডিট (আরএমসি) প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে।
কলাপাড়া উপজেলার দুর্গম এলাকা হিসেবে পরিচিত লালুয়া ইউনিয়নে তিন ক্যাটাগরিতে মোট ৬৮টি সমিতিতে এক হাজার ৪০৭ জন সদস্য রয়েছেন। এরমধ্যে আল্ট্রা পুওর (ইউপি) ২৭, রুরাল মাইক্রোক্রেডিট (আরএমসি) ৩৭ ও মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ (এমই) প্রকল্পে ৪টি গ্রুপ রয়েছে।
আলাপ হলো কোডেক লালুয়া শাখার ব্যবস্থাপক বিষ্ণু কুমার নাগ বলেন, এই কার্যক্রম গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াচ্ছে। দরিদ্র পরিবারগুলোকে টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি সদস্যদের সবজি চাষ, ছাগল পালন, ধানচাষ, সেলাই ইত্যাদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মমুখী করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্যোগকালীন সহায়তা হিসেবে সদস্যদের ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়া হয় নামমাত্র সুদে। জরুরি খাদ্য সংগ্রহ, লেট্রিন তৈরি, গবাদিপশুর ঘাস সংগ্রহ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় জরুরি ব্যয় ইত্যাদি খাতে এ টাকা ব্যয় করা হয়। এর মধ্যদিয়ে এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে।
লালুয়া ইউনিয়নে কোডেক সমন্বয় পরিষদ রয়েছে। সম্প্রতি এ পরিষদ বহুমুখী সমবায় সমিতি হিসাবে সরকারের সমবায় দপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে। এই সমিতির সভাপতি মো. জাকির হোসেন আকন বলেন, সার্বিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহায়তার লক্ষ্যেই এই পরিষদ গঠিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের কার্যক্রমে এরইমধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দরিদ্র মানুষ আর্থিকভাবে সাবলম্বিতার পথে এগোছে।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ০২৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৪