ধলঘাটা, মহেশখালী (কক্সবাজার) ঘুরে এসে: দীর্ঘ পথ হেঁটেও দেখা মেলে না সবুজের। বাড়ি আর রাস্তাঘাট দেখলে মনে হয় ক’দিন আগেই ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়েছে গোটা এলাকা।
উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার প্রান্তিক ইউনিয়ন ঘলঘাটার অবস্থা এমনটাই। সমুদ্র আর পাহাড় ঘেরা জনপদে ধলঘাটার চিত্রটাই যেন আলাদা। এই ইউনিয়নে চলাচলের জন্য যানবাহনের পথ নেই বললেই চলে। এলাকা থেকে শহরে যেতে হলে জোয়ার-ভাটার হিসাব করতে হয়। ভাটায় নদী শুকিয়ে গেলে এখান থেকে বাইরে বের হওয়ার সুযোগ কম। আর এরই প্রভাব জীবনের সব ক্ষেত্রে।
মাতারবাড়ির মগডেইল গ্রাম থেকে ধলঘাটার পথে বহু মানুষের সঙ্গে দেখা। প্রত্যেকের কথা শুনেই থমকে দাঁড়াতে হয়। কেউ সমুদ্র থেকে মাছ ধরে ফিরছেন, কেউবা লবণ মাঠে কাজে যাচ্ছেন। কেউবা গ্রামের দোকান থেকে কিছু সদায়পাতি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। কলা কিংবা সবজি ফেরিওয়ালাদের সঙ্গেও দেখা মিলল। সবারই আছে দুঃখ বেদনার অনেক গল্প। অসুখে পথ্য, প্রয়োজনে দ্রুত শহরে যাওয়া, দুর্যোগে নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরা এ এলাকার মানুষের কাছে অনেকটাই ‘কল্পনার’ মতো। কোনো কিছুই এদের কাছে সহজ নয়।
নাসির মোহাম্মদ ডেইল দিয়ে ধলঘাটায় প্রবেশ। বেড়িবাঁধের সঙ্গে সরু মাটির রাস্তা। ঠিকভাবে দু’পা ফেলাই কষ্টকর। কোনোভাবে পা ফসকে গেলে রক্ষা নেই। পড়ে যেতে হবে অন্তত দশ ফুট নিচে। অথচ এই রাস্তাটি এলাকার মানুষের নিয়মিত চলার পথ। নির্বিঘেœ মানুষজন এ পথেই চলাচল করে। বাসিন্দারা জানালেন, প্রায় চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় উদ্যোগে এই মাটির রাস্তাটি দেওয়া হয়েছে।
ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডে সামসুল আলমের দোকান। আলাপ নানা বিষয়ে। এই ওয়ার্ডে প্রায় তিন হাজার মানুষের বসবাস। এখানকার কিছু মানুষ লবণ চাষ করে, কিছু মানুষ সমুদ্র আর চিংড়ি ঘেরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু মানুষদের সংকটের কোনো শেষ নেই। একদিকে বেড়িবাঁধ নেই, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ সংকট প্রকট। বর্ষায় এই এলাকার মানুষ চলাফেরা করে নৌকায়। কাদামাটির রাস্তায় তখন হাঁটাচলা কঠিন।
স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, ধলঘাটা এমন একটি ইউনিয়ন, যেখানে যাতায়াতে পায়ে হাঁটা ছাড়া বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। কিছুদিন আগে টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও কাবিখার বরাদ্দে এই এলাকার বড় রাস্তাটি কিছুটা প্রশস্ত হয়েছে। তবে বর্ষায় এই কাদামাটির রাস্তায় চলাচল সম্ভব হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ।
নাসির মোহাম্মদ ডেইল থেকে পশ্চিম দিকে সুতরিয়া বাজার পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক আগেই। বাঁধ না থাকায় একদিকে বাড়িঘর ভেসে যায়। সমুদ্রে পানি বাড়লে গোটা ইউনিয়ন যেন পানিতে ভাসে। গত বর্ষায় ইউনিয়নের ৯ গ্রামের অন্তত ৮ হাজার মানুষ অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিল।
নাসির মোহাম্মদ ডেইল থেকে সুতরিয়া বাজারের দিকে আসতে সমুদ্র তীরে চোখে পড়ল বিপন্ন বাড়িঘর। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে এদের আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থাই নেই। এই এলাকার মানুষদের নিরাপদে আশ্রয়ের জন্য যে সাইক্লোন শেলটারটি ছিল, সেটি অনেক আগেই পরিত্যক্ত হয়ে এখন সমুদ্র গর্ভে হারানোর অপেক্ষায়। এই এলাকায় নতুন বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। কিন্তু সে কাজে ধীরগতি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
এক নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার নবীর হোসেন বলেন, বার বার বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণেই এলাকাটি সব দিক থেকে পিছিয়ে আছে। রাস্তাঘাট উন্নয়নে শুকনো মৌসুমে যেসব কাজ হয়, তা বর্ষায় নষ্ট হয়ে যায়। ফলে উন্নয়ন কাজের কোনো সুফলও এলাকাবাসী পাচ্ছে না। তবে শক্ত করে বেড়িবাঁধ নির্মিত হলে এলাকার অনেক সংকট কেটে যাবে।
ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পাওয়া তথ্য বলছে, শিক্ষা-চিকিৎসার ক্ষেত্রেও অনেকটাই পিছিয়ে ধলঘাটা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের তূলনায় অনেক কম। চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এই এলাকার মানুষদের চিকিৎসার জন্য যেতে হয় মহেশখালী, চকরিয়া কিংবা কক্সবাজারে। কিন্তু জরুরি সময়ে সেখানে পৌঁনোটাই ভাগ্যের ব্যাপার। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার আসে না। এলাকায় যেসব কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে, তা তেমনটা কার্যকর নয়।
ধলঘাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইদুল ইসলাম সাঈদ বলেন, ধলঘাটা একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এই বিচ্ছিন্নতাই এখানকার মানুষদের সবদিক থেকে পিছিয়ে রেখেছে। ধলঘাটার সঙ্গে কালারমার ছড়া ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের প্রস্তাব দীর্ঘদিনের। এটি না হওয়ায় ধলঘাটা যাতায়াতে একমাত্র ভরসা নদীপথ।
তিনি বলেন, ধলঘাটার সাপমারার ডেইল থেকে নৌকায় উঠে প্রায় একঘণ্টার নদীপথ পাড়ি দিয়ে তারপর পায়ে হেঁটে কালারমার ছড়া ইউনিয়ন সদরে পৌঁছাতে হয়। ধলঘাটার সার্বিক উন্নয়ন করতে হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি বেড়িবাঁধ নির্মাণ জরুরি।
ধলঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আহসান উল্লাহ বাচ্চু বলেন, লোকসংখ্যা কম আর আয়তনে ছোট বলে এখানে বরাদ্দ কম আসে। চাষি লবণের দাম পায় না। এলাকার মানুষকে সমুদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট সংস্তার ও প্রশস্তকরণের কাজও চলছে। এসব কাজ সম্পন্ন হলে এলাকার সমস্যা কিছুটা লাঘব হবে।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ০১১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৫