মহেশখালী (কক্সবাজার) ঘুরে এসে : একদিকে নিধন, আরেক দিকে মড়ক। বনখেকোদের দাপট বেড়ে চলেছে লাগামহীন।
কক্সবাজারের মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পাওয়া যায় এমন চিত্র। উপজেলা সদর গোরকঘাটা, সোনাদিয়া, ধলঘাটা, ঘটিভাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় বন ধ্বংসের দৃশ্য চোখে পড়ে।
ঘটিভাঙ্গা থেকে নদীপথে সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে দু’ধারে কেওড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়েছে বন বিভাগ। বছরে বছরে এসব বন বেশ ঘন হয়ে উঠেছিল। কিন্তু গাছ কাটা এবং মড়ক দু’টোই চোখে পড়ল এসব বনে। দূর থেকে ঘন বন মনে হলেও বনখেকোদের কারণে ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দ্বীপ সোনাদিয়ার সমুদ্রতীরের ঝাউবনের গাছে কুঠারের আঘাত পড়েছে। মাত্র ৭-৮ বছর বয়সী গাছগুলো দেদারছে কাটা হচ্ছে। দ্বীপের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন ঝাউ বাগানে গাছের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে।
অন্যদিকে দ্বীপের পশ্চিমে অন্তত দু’হাজার ঝাউগাছ মরে গেছে অজ্ঞাত কারণে। বন বিভাগের ধারণা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবনাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় গাছগুলো মারা যেতে পারে।
সূত্র বলছে, মহেশখালী চ্যানেলের গোরকঘাটা, চরপাড়া, মহেশখালী জেটি সংলগ্ন এলাকা, সোনাদিয়া, বড়দিয়া, পোকখালী, ঘটিভাঙ্গা, কালারমারছড়ার পশ্চিমে পাঁচটি বিট অঞ্চলে প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে মড়ক। উপজেলায় থাকা প্রায় ১৫ হাজার একর বনভূমির ৮০ শতাংশে আছে বাইন গাছ। এ গাছে সংক্রমণ বেশি হওয়ায় পুরো ম্যানগ্রোভ বনই ধূসর দেখাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, আক্রান্ত গাছের সবুজ পাতা দু’তিন দিনের মধ্যেই পুরোপুরি ধূসর করে ফেলছে এক ধরনের লেদা জাতীয় পোকা। এক গাছ থেকে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে আরেক গাছে।
মহেশখালীর গোরকঘাটা ও আদিনাথ মন্দির সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাইন গাছগুলোর পাতা হঠাৎ ধূসর হয়ে ঝরে পড়ছে। এক পর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে পুরো গাছ। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব থেকে বাঁচাতে দ্বীপের চারদিকে প্যারাবন সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হলেও, গাছের মড়কে সে উদ্যোগ ব্যর্থ হতে চলেছে।
মহেশখালী বন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, উপজেলার পাঁচটি বিটের প্রায় ১৭ হাজার একর প্যারাবনের বাইন গাছে ব্যাপকভাবে মড়ক লেগেছে। ১৯৮০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় প্যারাবন সৃজন করা হয়। এসব জায়গায় প্রায় ১৭ লাখ বাইন গাছ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া ও অজ্ঞাত পোকা আক্রমণ করায় হুমকির মুখে আছে প্যারাবন।
বন বিভাগের মহেশখালীর গোরকঘাটার রেঞ্জ কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ইকবাল বলেন, এর আগে কখনো বনে এমন সমস্যা দেখা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনটা হয়ে থাকতে পারে। বিষয়টি যথা সময়ে ঊর্ধ্বতন মহলকে জানানো হয়েছে।
মড়কের কারণে সোনাদিয়া দ্বীপের বনাঞ্চল হুমকির মুখে রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বন বিভাগের কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে একমত।
সোনাদিয়া বিট কর্মকর্তা জানালেন, মড়কের কারণে এ এলাকার বনাঞ্চল হুমকিতে রয়েছে। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে এমন মড়কের উপক্রম হয়। নভেম্বর শেষ না হতে ধূসর হয়ে গেছে ম্যানগ্রোভ বনের বিস্তীর্ণ এলাকা।
বাইন গাছ থেকে মড়কের উৎপত্তি বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের কর্মকর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দারা। কক্সবাজার উপকূলে থাকা ম্যানগ্রোভ বনের ৮০ শতাংশে আছে বাইন গাছ। এ কারণে দ্রুত আক্রান্ত হচ্ছে গোটা বন। তবে বন বিভাগ বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নের ঘটিভাঙ্গা এলাকা থেকে সোনাদিয়া পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে সৃজিত হয়েছে নতুন বন। রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার সময় বাইরে থেকে চোখে পড়ে ঘন বন। কিন্তু একটু ভেতরের দিকে নজর দিলেই দেখা যায় বন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এক শ্রেণির ‘বনখেকো’ এ বন থেকে গাছ কেটে বিভিন্ন কাজে লাগাচ্ছে।
বনের গাছ কাটা রোধে বন বিভাগের গোরকঘাটার রেঞ্জ কর্মকর্তা জানালেন অসহায়ত্বের কথা। তিনি বলেন, মহেশখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে বন বিভাগের সৃজিত বেশকিছু বন রয়েছে। এগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসাবে সোনাদিয়া দ্বীপের প্রতি আমাদের বিশেষ নজর রয়েছে। তবে লোকবল সংকটের কারণে সার্বক্ষণিক সব এলাকায় নজর রাখা সম্ভব নয়। বন রক্ষায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতা চান তিনি।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৫