দুর্যোগ-দুর্বিপাকে উপকূলে বিপন্নতা বাড়ে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বাড়িঘর।
কারও ঠিকানা মেলে শহরের রাস্তার ধারে। কখনো জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব, কখনো বা অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর ডুবে যাওয়া। বর্ষায় ভাঙনের চিত্রটা এখন একেবারেই স্বাভাবিক। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপকূলে বাড়ছে এই দুর্যোগের ঝুঁকি। দুর্যোগ মৌসুমে উপকূলবাসীর দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। ঝুঁকি বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। তবু উপকূল থেকে যায় অরক্ষিত।
এইসব নিয়ে অরক্ষিত উপকূল শিরোনামে বাংলানিউজের আট পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব
উপকূলের বিপন্ন জনপদ ঘুরে: এক একটা ঝড়ের মৌসুম আসে, আর উপকূলের মানুষ নতুন করে টিকে থাকার প্রস্তুতি নেয়। সব সময়ই বড় দুর্যোগের প্রস্তুতি থাকে। কিংবা বড় দুর্যোগ না এলেও বর্ষায় বেড়ে ওঠা জোয়ারের পানি আর ঢেউয়ের ঝাপটা থেকে বাঁচতে সমুদ্র পাড়ের মানুষদের বার বার বাড়িঘর গোছানোর পালা। সামান্য ঝড়ে যেন ঘরটা পড়ে না যায়, কিংবা চালাটা উড়ে না যায়, সেজন্যে চলে নানা আয়োজন।
এবার দুর্যোগ আর বর্ষা মৌসুমের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে উপকূলের বিভিন্ন স্থানে বাড়ি বদলের কিংবা বাড়িঘর গোছানোর হিড়িক পড়ে যায়।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ, চকরিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, লক্ষ্মীপুরের কমলনগর, রামগতিসহ বিভিন্ন এলাকার বিপন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে সেই প্রস্তুতির বিবরণ। ঝুঁকি আর আতঙ্কের কারণেই এই প্রস্তুতি।
তারা মনে করেন, উপকূল এখনও অরক্ষিত। উপকূল সুরক্ষায় সরকারের বিশেষ কোনো নজর নেই। আর সে কারণে দুর্যোগে টিকে থাকতে আজন্ম লড়াই করতে হয় উপকূলের জনগণের।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দক্ষিণে তাবালর চর। আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের আট নম্বর ওয়ার্ড। পাশেই সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। নিচু বাঁধ ছুঁয়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। এ যেন সমুদ্রের সঙ্গে বসবাস। তির-চার বছরের শিশুদের খেলাধুলা থেকে শুরু করে বাড়ির নানা কাজকর্ম সমুদ্রের পাশেই চলে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষায় ‘সুদিনে’ (শুকনো মৌসুমে) সমুদ্র তাদের ‘বন্ধু’ হয়ে থাকে। কিন্তু বর্ষার ছয় মাস সমুদ্রের সে রূপ বদলে যায়। ঝড়ের ঝাপটা সরাসরি এসে এই তাবালর চরের মানুষদের বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড করে দেয়। তখন সমুদ্রপাড়ের মানুষদের জীবনে নেমে আসে চরম দুর্দিন। বেড়ে যায় জীবনের সংকট। কাজের অভাবে কেউ দুই/এক বেলা না খেয়ে থাকলেও এদের খোঁজ কেউ নেয় না। কথা বলার সময় ভিড় করা মানুষেরা সেসব কথাই জানাচ্ছিলেন।
দিনমজুর আব্দুল জব্বারের ছোট্ট ঘরটা তাবালর চরে সমুদ্রের পাশে বাঁধের ঢালে। বাতাসের তোড়ে যেন ঘরটা ভেঙে না পড়ে সেজন্যে ঘরের চারিদিকে রশি টানা দিয়ে রাখা হয়েছে। দেখে মনে হয় এই রশিগুলো মাছধরা ট্রলারের পুরানো রশি। চালার ওপরে দেওয়া হয়েছে লবণ মাঠে ব্যবহৃত পুরানো কালো পলিথিন। এর ওপর আবার রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া টুকরো টুকরো ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জব্বার বললেন, যতটুকু সাধ্য আছে, তা দিয়েই ঘরটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। নতুন মালপত্র কিনে ঘরটা আরও মজবুত করার সাধ্য তো আমাদের নেই। সারাবছরই এই ঘর গোছানোর কাজ চলে। তবে বর্ষার আগে ঘরের দিকে একটু বেশি নজর দিতে হয়।
পাশেই আরেকজন মফিজুল ইসলাম। নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। কখনো লবণ মাঠে ঘাম ঝরানো, কখনো সমুদ্রে মাছ ধরা। বার বার জীবিকার এই পালাবদলের পরও দুর্যোগের মৌসুম সামনে রেখে ঘরটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হয়। ঘরে টিনের চালা দেওয়ার সামর্থ্য নেই বলে পুরানো পলিথিনের ওপরে পরিত্যক্ত মাছধরার জাল বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। জোয়ারের পানি যাতে ঘরে ঢুকতে না পারে, সেজন্যে তার ঘরের চারপাশে মাটি উঁচু করে দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের বাংলাবাজার এলাকার বাঁধের পাড়ের মানুষেরা বর্ষাকালের পানি আর ঝড়-বাতাসের ভয়ে ঘর শক্ত করার কাজে ব্যস্ত। উপজেলার সর্বদক্ষিণের এই এলাকাটি শুধু বর্ষায় নয়, সারা মৌসুমেই দুর্যোগ ঝুঁকিতে থাকে। বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে নদীতে। কখন ঘরটি ভেঙে চলে যায়, সেই আতঙ্কের সঙ্গে তাদের আবার ঝড়-ঝাপটার ভয়ে ঘরটি শক্ত করে বাঁধতে হচ্ছে।
সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের বেড়ির বাইরের এই এলাকায় থাকেন মোমেনা বিবি। স্বামী আজিজ উল্লাহ বেঁচে নেই। দুই ছেলেসহ তাদের ঘরটিতে সদস্য সংখ্যা আট। দুর্যোগের সময় এই মানুষগুলোর নিরাপত্তায় ঘরটি বিভিন্নভাবে শক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। পলিথিনের ওপরে কিছু খরকুটো দিয়ে তার ওপর পুরানো মাছধরার জাল ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাটির নিচে গাছের গুঁড়ি পুঁতে রশি লাগিয়ে ঘরের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে টানা।
বর্ষার আগে উপকূলের এইসব এলাকায় এমন নানা প্রস্তুতি চোখে পড়ে। নতুন ঘর বানানো, ঘর মেরামত করা, বাড়ির চারপাশ মাটি দিয়ে উঁচু করাসহ নানান দৃশ্য চোখে পড়ে এসময়। এ যেন নিজেদের মতো করে একটা মৌসুম বেঁচে থাকার চেষ্টামাত্র। ঘরটাকে একটু শক্ত করার এই চেষ্টা আদৌ এদের ঝড় থেকে বাঁচাতে পারবে কিনা তা কেউ জানে না।
সন্দ্বীপের রহমতপুর ইউনিয়নের পশ্চিম প্রান্তে মেঘনা নদীর গা ঘেঁসে জেগে থাকা গ্রামের বাসিন্দা সফিকুল ইসলাম বলেন, দুর্যোগের পর আমাদের কাছে সবাই আসে। কিন্তু দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য আমরা কীভাবে আরও ভালো প্রস্তুতি নিতে পারি, সে বিষয়ে কেউ সহায়তা করে না।
সমুদ্র কিংবা নদীতীরের ঝুঁকির মুখে থাকা বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুকনো মৌসুমে মোটামুটি নিরাপদে বসবাস করতে পারলেও বর্ষাকাল সামনে রেখে তাদের থাকে নানা আয়োজন। কেউ কেউ এই সময়ের জন্য কিছু বাড়তি সঞ্চয় করে রাখেন। অনেকে বাড়িঘর সরিয়ে নেওয়ার জন্য বিকল্প স্থান ঠিক করে রাখেন। সরকারি বেসরকারি প্রচারণার ফলে দুর্যোগের কিছু বার্তা পেয়ে প্রস্তুতির ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। সিগন্যাল পেলে এখন তারা ঘরে শুকনো খাবারও রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এসবের পরেও তাদের ঝুঁকি থেকেই যায়।
রহমতপুর ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার বলেন, দুর্যোগের ওপর আমাদের হাত নেই। দুর্যোগ হয়ে গেলে হয়তো কিছু সাহায্য করা যায়, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য দুর্যোগের প্রস্তুতির ওপর আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত। শক্ত করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৫
আরআইএম/এসআই