দুর্যোগ-দুর্বিপাকে উপকূলে বিপন্নতা বাড়ে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বাড়িঘর।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপকূলে বাড়ছে এই দুর্যোগের ঝুঁকি। দুর্যোগ মৌসুমে উপকূলবাসীর দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। ঝুঁকি বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। তবু উপকূল থেকে যায় অরক্ষিত। এসব নিয়ে অরক্ষিত উপকূল শিরোনামে বাংলানিউজের আট পর্বে ধারাবাহিকের বৃহস্পতিবার পড়ুন সপ্তম পর্ব।
উপকূলের বিপন্ন জনপদ ঘুরে: ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে তছনছ হয় উপকূলের জনপদ। সারাজীবনের সঞ্চিত সম্পদ হারিয়ে যায় মুহূর্তে। ম্যারি এন, সিডর, আইলা, মহাসেন, রেশমা-সহ বহু নামের ঘূর্ণিঝড় উপকূল জুড়ে প্রলয় বয়ে আনে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সব হারানো মানুষের পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয় না। পূর্বে টেকনাফ থেকে শুরু করে পশ্চিমে সুন্দরবন পর্যন্ত সব এলাকার মানুষের একই কথা।
তারা বলেছেন, প্রতিনিয়ত ঝুঁকিতে থাকা উপকূলে আরেক বিপদ নিয়ে আসে ঘূর্ণিঝড়। এর ওপর জলোচ্ছ্বাসের মত দুর্যোগ তো বর্ষা মৌসুম জুড়েই থাকে।
সরেজমিনে পাওয়া তথ্য সূত্র বলছে, এক একটি ঝড়ের পর এলাকায় প্রচূর পরিমাণে সাহায্য এলেও দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের অবস্থা সেই আগের মতই। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আসা সহায়তার অধিকাংশই জরুরি খাদ্য সহায়তা হওয়ায় বিপন্ন মানুষদের ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা খুব একটা হয়নি। সাহায্য হিসাবে পাওয়া ঘরে থাকার পরিবেশ থাকে না। সারা জীবনের জমানো সম্পদ হারিয়ে বহু মানুষকে চরম সংকটে দিন কাটাতে হয়। দেনার বোঝা বয়ে বেড়াতে হয় তাদের।
বাগেরহাটের সর্বদক্ষিণে শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের সর্বদক্ষিণে বলেশ্বর নদী তীরবর্তী এলাকায় আঘাত হেনেছিল সিডর। ভয়াবহ এই প্রলয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া গ্রামগুলো ফিরে পেয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। বাড়িঘর উঠেছে, গাছপালা মাথা তুলেছে, জেলেরা আবার জালনৌকা নিয়ে আবার ফিরছে নদীতে। কিন্তু এই প্রাণচাঞ্চল্যে যেন কোন ‘প্রাণ’ নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নিতান্তই বেঁচে থাকতে হয় বলে মানুষগুলো জীবন সংগ্রামে মনোযোগ দিয়েছে।
সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সাউথখালী ইউনিয়নের গাবতলা, উত্তর ও দক্ষিণ সাউথখালী গ্রাম ঘুরে বাংলানিউজ বিপন্ন মানুষদের বোবা কান্না অনুভব করতে পেরেছে। একই সঙ্গে বাবা-মা-বোন হারানোর বেদনা, ছেলে কিংবা মেয়ে হারানোর বেদনা কী করে ভুলে যাবে এই এলাকার মানুষ। দুর্যোগ যেন এক একটি জীবনই বদলে দিয়েছে। হয়তো ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনি সবাই চলে গেছে, শুধু বেঁচে আছেন একজন বৃদ্ধা। ঘরসহ সাহায্য সহযোগিতার অনেক কিছুই বেঁচে থাকা এই বৃদ্ধার ভাগ্যে জোটেনি, কারণ তার নিজের নামে কিছুই ছিল না। এভাবে ভাসমান অনেক মানুষের কান্নায় এখনও ভারি হয়ে আছে সাউথখালীর বাতাস।
সাউথখালী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন থেকে খানিক দূরে পুরনো লঞ্চঘাট। এক সময় এখানে জমজমাট ঘাট ছিল। লঞ্চ আসতো বিভিন্ন এলাকা থেকে। সেই ঘাটটি বহু আগে বলেশ্বরের স্রোতে হারিয়ে গেলেও এখনও এলাকাটিকে সবাই লঞ্চঘাট হিসাবেই চেনে। সিডরের পানির তোড়ে এই এলাকার বাড়িঘর ভেসে গিয়েছিল। ভেসে যাওয়া মানুষেরা সিডরের পরের ভোরে এসে নিজের বাড়ি চিনতে পারেননি। সেই মানুষগুলো এখনও সেখানেই বসবাস করছেন। সেই আগের পেশা, আগের মতই ধুঁকে চলা।
নদীতীরে নতুন বেড়ি বাঁধের গা ঘেঁসে আবদুল মালেক মৃধার ছোট্ট ঘর। সিডরের পর ত্রাণ হিসাবে একটা ঘর পেয়েছিলেন। কিন্তু এ ঘরটা এতই ছোট ছিল যে, চারদিকে বারান্দা দিয়ে ঘরটি বড় করতে হয়েছে। দুই কক্ষের যে ঘর পেয়েছিলেন, তাতে বসবাস করা সম্ভব ছিল না। মালেক পুরানো পেশায় ফিরতে আবার জালনৌকা তৈরিতে মনযোগ দিয়েছেন। সিডরের আগে একটা বড় ট্রলার থাকলেও এখন বানিয়েছেন ছোট্ট ট্রলার। ত্রাণ হিসাবে ১০ কেজি মাছ ধরার জাল পেয়েছিলেন। কিন্তু এর সঙ্গে আরও কিনতে হয়েছে। এসব করতে গিয়ে তিনটি এনজিওতে দেনা আছেন প্রায় এক লাখ টাকা। অন্তত বছর খানেক এই দেনা বইতে হবে তাকে।
আরেকজন আবদুল কাদের। পুরানো লঞ্চঘাটের কাছে নতুন বেড়ি বাঁধ থেকে খানিক দূরে রাস্তার পাশে ছোট্ট ঘর। একখানা ত্রাণের ঘর তার ভাগ্যেও জুটেছে। কিন্তু একই অবস্থা। ঘরটি খুবই ছোট হওয়ায় আশপাশে বারান্দা দিয়ে ঘর বড় করতে হয়েছে। তিনিও প্রায় এক লাখ টাকা দেনা আছেন। আব্দুল কাদের বাংলানিউজকে বলছিলেন, সিডরের পর প্রায় তিন মাস আমরা কাজ না করেই খাবার পেয়েছি। কিন্তু এক পর্যায়ে তো আমাদের কাজে নামতে হয়েছে। মাথা তোলার মত সহায়তা খুব সামান্যই মিলেছে।
সরেজমিনে বলেশ্বর তীর ও সুন্দরবন লাগোয়া গ্রাম ঘুরে দেখা গেলো, সিডরে পথে বসে যাওয়া মানুষ পুনরায় বেঁচে থাকার চেষ্টায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কেউ দোকান করেছে, কেউ নৌকা মেরামত করে আবার নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কেউবা মাছের পোনা ব্যবসায় নেমেছেন। আলাপে অনেকেই অভিযোগ করলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের ঘুরে দাঁড়াতে যে সহায়তা এসেছে, তা যথাযথভাবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছেনি। আর সে কারণেই বহু মানুষ দেনার ভারে ন্যূয়ে পড়েছে।
সিডর পরবর্তী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নকারী স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা অগ্রদূত ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আইউব আলী আকন বাংলানিউজকে বলেন, সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠায় এই এলাকার বিপন্ন মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সিডরের পর বিভিন্ন ধরণের কাজের সুযোগ হয়েছে এ এলাকায়। এখনও হচ্ছে। কিন্তু এ কাজে স্থানীয় মানুষদের পাওয়া যায় না। একমাত্র অলসতাই তাদেরকে পিছিয়ে রেখেছে।
আইলা বিধ্বস্ত খুলনার দাকোপের কামারখোলা ও সুতারখালি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, কেউ বাঁধের ওপর, কেউ অন্যের জমিতে, আবার কেউবা পরিবার পরিজন নিয়ে নদীর ধারে খোলা স্থানে ঘর বানিয়ে কোনমতে মাথা গুঁজে আছে। কারও গেছে ফসলি জমি, কারও ঘরবাড়ি, আবার কেউবা হারিয়েছে চিংড়ির খামার। অবশিষ্ট নেই কিছুই। সবুজ-শ্যামল ছায়াঘেরা বাড়িটি এখন যেন কেবল স্মৃতি হয়েই আছে।
সরকার-এনজিও বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও আইলা বিধ্বস্ত জনপদের মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পারেনি। এই দু’টি ঘূর্ণিঝড়ের পরেই এই এলাকায় সরকারি-বেসরকারি ও দাতাগোষ্ঠীর তরফে ব্যাপক সাহায্য সহযোগিতা এসেছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের টেকসই জীবন নিশ্চিতকরণে তা তেমনটা কাজে লাগেনি।
এলাকাবাসী বলছেন, সাময়িক সাহায্য পেয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা সংকটকাল অতিক্রম করেছে। ঘর নির্মাণসহ পুনর্বাসন খাতে পাওয়া সাহায্যও সংকটকালের ধকল সামলাতেই শেষ হয়ে গেছে। কর্মসংস্থান পাওয়া কিংবা ক্ষেতে ফসল পাওয়া পর্যন্ত সাহায্য অব্যাহত থাকলে মানুষগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারতো।
আইলায় খুলনার দাকোপ উপজেলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় কামারখোলা ও সুতারখালি ইউনিয়নের। পূর্বে ভদ্রা, পশ্চিমে ঢাকী ও শিবসা, উত্তরে ঢাকী ও ভদ্রা এবং দক্ষিণে ভদ্রা ও শিবসা নদী ইউনিয়ন দু’টিকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। নদী পেরিয়ে কামারখোলা ইউনিয়নে পৌঁছুতেই নদীর ধারে ও বাঁধের পাশে চোখে পড়ে বহু বিপন্ন মানুষের বসতি। কেউ নতুন করে ঘর বানাচ্ছেন, কেউবা ঘর মেরামতে ব্যস্ত। দাকোপ খেয়াঘাট থেকে কামারখোলা ইউনিয়নের কালিনগর বাজার পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার পথে একই দৃশ্য চোখে পড়ে। আর কালিনগর বাজারে মানুষের কষ্টের কথা জানতে গেলে অভাব-অভিযোগ জানাতে ভিড় জমে বহু মানুষের।
এলাকাবাসী বলেন, সিডর-আইলার পর এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ নিজের চেষ্টায়ই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আইলায় গোটা এলাকায় পানি ঢুকে পড়ায় দু’বছর কোন ফসল হয়নি। গত বছর প্রথমবারের মত ধান আবাদের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ফলন মার খেয়েছে। মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে। অনেক স্থানে বালু স্তুপ আকারে জমে আছে। এসব কারণে আবাদি জমির ৬০ ভাগ এখনও পতিত রয়ে গেছে।
কামারখোলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সমরেশ রায় বাংলানিউজকে বলেন, দুর্যোগের পর মানুষ চরম সংকটে পড়ে। তাদের তিনবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। ক্ষতিগ্রস্তরা ঘর বানানোর জন্য ২০ হাজার টাকা করে সরকারি সাহায্য পেলেও তা সংকট কাটাতেই খরচ হয়ে গেছে। তাই আর ঘর বানানো হয়নি। অনেকে ধারদেনা করে দু’বছর জমি আবাদ করেছে; কিন্তু ফসল মার খাওয়ায় আবার নতুন করে দেনায় জড়িয়েছে।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ম্যারি এন-এর আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল পূর্ব ও মধ্য উপকূলে। এসব অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, সব হারানো মানুষদের অনেকেই ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। একই অবস্থা সাম্প্রতিক মহাসেন, রেশমাসহ অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের। উপকূলবাসী বার বার সব হারায়। তবুও উপকূলের মাটি অঁকড়ে ধরে লোনা পানির সঙ্গে বসবাস করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৫ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৪
জেডএম/
উপকূল থেকে উপকূল
অরক্ষিত উপকূল-৭
দুর্যোগের ‘ক্ষত’ বদলে দেয় জীবনের গতি
রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।