ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

ঢালচরে ডাকাত আতঙ্ক

নারীরা নির্যাতনের শিকার, নিরাপত্তাহীন জেলেরা

ছোটন সাহা, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৫
নারীরা নির্যাতনের শিকার, নিরাপত্তাহীন জেলেরা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢালচর, মনপুরা থেকে ফিরে: 'দিনে ডাকাতি আর রাতে নারীদের ওপর নির্যাতন। ঘরে নিরাপত্তা নেই, তাই ডাকাতদের ভয়ে রাতে আশ্রয় নিতে হয় বাগানে।

শুরু হচ্ছে মাছের মৌসুম। এর সঙ্গে শুরু হবে ডাকাতদের তাণ্ডব। চোখের ঘুম কেড়ে নেবে ডাকাতরা।

এ কথাগুলোই বলছিলেন ভোলার মনপুরা উপজেলার ঢালচরের গৃহবধূ নাছিমা। তিনি বলেন, চরে কোন নারী নিরাপদে থাকে না। তাদের নিরাপত্তা না দিলে চরটি নারী শূন্য হয়ে যাবে।

গৃহবধূ জরিনা বলেন, গরিবের টাকা-পয়সা নেই, আছে ইজ্জত। ডাকাতরা তাও কেড়ে নিতে চায়। ডাকাতদের ভয়ে অনেকেই গ্রাম ছাড়া। ভয়ে কেউ মুখ খুলে না। প্রতিবাদ করার সাহস নেই কারো। ডাকাত দমন না হলে চরের উন্নয়ন হবে না।

ডাকাতদের ভয়ে এমন আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা শুধু নাছিমা ও জরিনার নয়। এ আতঙ্ক চরের নারীদের।

ভোলার মনপুরা উপজেলার পিছিয়ে পড়া দুর্গম এক জনপদ চর ডেমপেয়ার বা ঢালচর। এ চরে দস্যু আতঙ্ক এখন প্রতিটি ঘরে ঘরে। দস্যুরা দিনে জেলে ট্রলারে হানা দেয়, রাতে বসত বাড়িতে। প্রান্তিক জনপদের মানুষ ডাকাতদের কারণে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত চার বছর ধরে এ চরে পঞ্চাশের অধিক নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু নারীদের নিরাপত্তায় কোনো ব্যবস্থা নেই বলে অভিযোগ চরবাসীর।
 
তাদের অভিযোগ, জন নিরাপত্তায় নজর নেই স্থানীয় প্রশাসনের। বিভিন্ন সঙ্কটের মধ্যেও ডাকাতি দমন হলে সবাই নিরাপদে থাকতে পারবে। কিন্তু সেদিকে খেলায় নেই কারো।

সরেজমিনে ঘুরে চরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে দস্যুদের সেই লোমহর্ষক কাহিনী। ঢালচরে বাস করে প্রায় ৩ হাজার মানুষ। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই জেলে ও কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু মাছের মৌসুম এলে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়। বিশেষ করে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়।

চরের স্বামী পরিত্যক্তা নারী বেলি (ছদ্মনাম)। গত ১০ বছরে চারবার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু আজো বিচার পাননি তিনি।

নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, তিন বছর আগে ডাকাতরা তার বাড়িতে হানা দেয়। চোখ-মুখ বেধে তুলে নিয়ে যায় তাকে। মেঘনার উপকূলবর্তী জাগলার চরে আটকে রেখে টানা ১৪ দিন নির্যাতন করে ডাকাতরা। একপর্যায়ে কৌশলে ডাকাতদের কবল থেকে পালিয়ে আসেন তিনি।

বেলি আরো বলেন, শুধু তিনি নন, তার মতো অনেক নারী নির্যাতনের শিকার। এদের মধ্যে তার এক প্রতিবেশীর স্ত্রীকে দুই বছর আগে ডাকাতরা তুলে নিয়ে যায়। এখনও তার সন্ধান মেলেনি। স্ত্রীকে না পেয়ে তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। কিন্তু সেই স্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়েও আতঙ্কে রয়েছেন তিনি।

ডাকাতের হাতে অপহৃত আরেক নারী মান্নানের স্ত্রী আমেনা (৪০) বলেন, গত বছর মাছ ধরার মৌসুমে তিনিসহ তার পরিবারের সাত সদস্যকে তুলে নিয়ে যায় ডাকাতরা। তাদের সামনেই ৪/৫ জন নারীকে ধর্ষক করে ডাকাতরা। ডাকাতদের নির্যাতনে রিনা (১৩) নামে এক কিশোরী মারা যায়।

চরের নারীরা জানান, গত মৌসুমেই তাদের পাড়ার কয়েক গৃহবধূ ও তরুণী ডাকাতদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনার পর থেকেই সম্ভ্রম রক্ষায় নারীরা রাতে বাগানে-জঙ্গলে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে।

জেলে সাহাবুদ্দিন জানান, ডাকাতদের ভয়ে মেয়েকে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন। কিশোরী মেয়েকে কিভাবে রক্ষা করবেন সে চিন্তায় দিশেহারা তিনি।

চরের বাসিন্দা বেলায়েত হোসেন (৭০) বলেন, চরে বেশ কিছু লাঠিয়াল ও দস্যু রয়েছে। তারা চরে গরু লুট করে। মাছ-ট্রলার লুট করার পর অপহরণ করে জেলেদের। মুক্তিপণ পেলে তাদের ছেড়ে দেয়।

ডাকাতের কবলে পড়া বৃদ্ধ রব হাওলাদার বলেন, নদীতে মাছ শিকারে গিয়ে দুই বার ডাকাতের কবলে পড়েছি। মহিষ বিক্রির টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছি।

চরের বাসিন্দা কাউয়ুম, রফিক, সিরাজ, ইলিয়াস, রশিদ জানান, গত বছর ঢালচরে কোস্টগার্ড ক্যাম্প থাকায় চরে অনেক ডাকাতি কম হয়েছে। কিন্তু এ বছর ক্যাম্প উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন আবার শুরু হবে ডাকাতদের তাণ্ডব।

তুলাগাজীর তালুক গ্রামের জেলে কাদের বলেন, ১৪ বছর ধরে নদীতে মাছ শিকার করে আসছি। সব সময়ই নদীতে ডাকাতের উপদ্রব ছিলো। তবে, কোস্টগার্ড ক্যাম্প স্থাপন করায় ডাকাতির ঘটনা কম ছিল। এখন ক্যাম্প তুলে নিয়েছে। আবার শুরু হবে ডাকাতি।

এসহাক মাঝি বলেন, পুলিশ কিংবা কোস্টগার্ডে ক্যাম্প না থাকলে চলতি মাছ ধরার মৌসুমে কোনো জেলে ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা পাবে না।

রফিক মাঝি বলেন, জেলেদের জাল লুট করে আর রাতে চরে হানা দিয়ে নারীদের তুলে নিয়ে নির্যাতন করে ডাকাতরা। বেশ কয়েকটি চক্র চরকে অশান্ত করে তুলছে।

প্রায় ১২০ বছরের পুরনো ঢালচরে জনবসতি গড়ে উঠলেও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। লাঠিয়াল, জোতদার, দস্যু ও ডাকাতদের কারণে শান্তি ফিরছে না চরে। প্রশাসনের নজরে না আসায় অসহায় জেলেরা সর্বস্ব হারালেও ডাকাতি বন্ধ হচ্ছে না।

আবার শুরু হতে যাচ্ছে মাছ ধরার মৌসুম। প্রতিবছরের মতো এবারো তৎপরতা শুরু হয়েছে দস্যুদের। বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে তারা। চরে একটি কোস্টগার্ড সিসিএমসি স্টেশন হওয়ার খবরে জেলে ও মৎস্য আড়ৎদারদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এলেও আবারো তাদের মুখ মলিন। হতাশ তারা। অজ্ঞাত কারণে কোস্টগার্ড স্টেশন হচ্ছে না। একটি অস্থায়ী ক্যাম্প থাকলেও সেটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

এদিকে চরে কোস্টগার্ড ক্যাম্প পুনঃস্থাপনের দাবিতে ঢালচর ও তুলা গাজীর তালুক গ্রামের বাসিন্দারা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। বিক্ষোভ মিছিল ও মানবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাদের দাবি, বিগত মাছ ধরার মৌসুমে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও এ বছর তারা পুরোপুরি অনিরাপদ।

চরের নারী রোজিনা, সবুজ বিবি ও আকলিমাসহ অন্যরা জানান, অবহেলিত চরে জীবন সংগ্রাম করে মানুষ বেঁচে থাকলেও যেন তাদের শান্তি নেই। একের পর এক বিপর্যয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তারা।

জেলে বধূ মুক্তা বলেন, চরে একের পর এক নারী নির্যাতন হচ্ছে। গত মৌসুমে সীমা নামের একটি নারীকে নির্যাতন করে ডাকাতরা। ওই ঘটনার পর থেকে সীমা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।

জেলে জসিম ও গৃহবধূ খাদিজা বলেন, ডাকাতের অত্যাচারে আগে থেকেই তাদের সন্তানদের মূল ভূ-খণ্ডে নিয়ে এসেছেন।

শুধু তারা নন, ডাকাতদের ভয়ে পালিয়ে এসেছেন নাছির, দিনা, তালু মাঝি, মনির ও রাশেদসহ অন্য জেলে পরিবারগুলো।

কোস্টগার্ড ক্যাম্প তুলে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন কাউসার আলম বাংলানিউজকে জানান, মন্ত্রণালয় ও সদর দপ্তরের নির্দেশে ক্যাম্প তুলে নেওয়া হয়েছে। আমাদের জনবল সঙ্কট রয়েছে।

মনপুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এরশাদ হোসেন খান জানান, চরে অনেক সমস্যা রয়েছে। তবে, এ মুহূর্তে চরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জরুরি। বিষয়টির সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।

ভোলার জেলা প্রশাসক সেলিম রেজা বাংলানিউজকে জানান, চরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চরে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও ভবিষ্যতে যেন আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে জন্য পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কোস্টগার্ড সিসিএমসি স্টেশন বিষয়ে তিনি বলেন, জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ থাকায় আপাতত ক্যাম্প স্থাপন প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। তবে, ভবিষ্যতে স্থাপন করা হতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ০৪২২ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৫     
এমজেড/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।