ফরিদপুর: সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৭৪ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে আর ফরিদপুরের বিভিন্ন চরাঞ্চলে বাল্যবিয়ের প্রবণতা প্রায় শতভাগ।
ফরিদপুরের চরমাধবদিয়া ইউনিয়ন।
বিয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটক ও কাজী অর্থের লোভে এবং মেম্বার-চেয়ারম্যানরা বাধা না দিয়ে ভোটের সম্পর্কের কারণে গোপনে সহায়তা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
চরমাধবদিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, প্রায় শতভাগ বাল্যবিয়ে হয় এখানে। চরমাধবদিয়া ইউনিয়নে চলতি বছর শতাধিক বিয়ের প্রায় শতভাগই বাল্যবিয়ে হয়েছে বলে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (রাসিন) প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।
রাসিনের নির্বাহী পরিচালক আসমা আক্তার মুক্তা বলেন, গত ছয়মাসে অর্ধশতাধিক মেয়ের বিয়ের ওপর জরিপ চালিয়ে ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে শতভাগ বাল্যবিয়ে হয়েছে চরমাধবদিয়া ইউনিয়নে।
বাল্যবিয়ের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় গাফিলতি করা যাবে না। শুধু প্রশাসন নয়, আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এ অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য বলেও মন্তব্য করেন নারীনেত্রী মুক্তা।

এ ইউনিয়নের ইয়াছিন শেখের ডাঙ্গি গ্রামে ১৬ বছর আগে বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে স্বামীর সংসার করছেন আসমা আক্তার (৩০)। সংসারের কাজের পাশে খেতে গিয়েও কৃষক স্বামীকে সাহায্য করেন এই নারী।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আজ থেকে ১৬ বছর আমিও বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছি। লেখাপড়ার স্বপ্ন কখন যে ভেঙ্গে গেছে, বুঝতেই পারিনি। মাত্র ৩০ বছর বয়সেই আমি মনে হয় বুড়ো হয়ে গেছি, সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় নানা রোগে ভুগছি। দু’দিন শরীর ভালো থাকলে তার তিনদিনই খারাপ থাকে এখন’।
আসমা বলেন, ‘আমি যদি বাল্যবিয়ের শিকার না হতাম তবে আমার জীবন আজ এমন হতো না। আমার মতোই এ গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামেও ১৪/১৫ বছর হলেই পরিবারগুলো মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে’।
‘তবে স্বামী বা স্বামীর পরিবারের কাছ থেকে কোনো সমস্যা নেই আমার। তাই বিবাহিত জীবনে হয়তো আমি কষ্টে নেই’- বলেন তিনি।
তারপরও অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে আর সংসারের কাজ করতে গিয়ে আজ হাঁপিয়ে ওঠা এক নারী আসমা।
চরমাধবদিয়া ইউনিয়নে যে অহরহ বাল্যবিয়ে হয় তা জানেন আসমা। নানা কারণে চর এলাকায় বাল্যবিয়ে হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, নদীভাঙা মানুষের বসবাস এখানে। অতিদরিদ্র এসব পরিবার বিয়ের সম্পর্ক এলেই যেন রাজি হয়ে যায়। বিয়ে দিতে পারলেই যেন দায় থেকে মুক্তি মেলে ভিটা-বাড়িহীন মানুষগুলোর।
এছাড়া সমাজের মান-সম্মানের ভয়, টিভি সিরিয়াল বা অপসংস্কৃতি আর সমাজ ব্যবস্থাকেও দায়ী করলেন আসমা।

এছাড়া কারণ হিসেবে বললেন, ‘মেয়েরা যেন পরিবারের কাছে এখনো বোঝা। প্রেম করে পালিয়ে যাবে এমন ভয়েও বাল্যবিয়ে হচ্ছে’।
তবে এমন কথা মানেন না ওই গ্রামের কলেজ পড়–য়া মেয়ে সুমাইয়া। তিনি বলেন, ‘কোনো বাড়ির একটি মেয়ের পালিয়ে যাওয়ার কারণে হয়তো অনেক মা-বাবার মনে ভয় হয়। কিন্তু গত এক বছরের কথা যদি বলি, তবে কয়টি মেয়ে পালিয়েছে? দুই তিনজনও না’।
‘তবে তিনজন মেয়ের জন্য কি হাজার মেয়ের বাল্যবিয়ে হবে?’ প্রশ্ন রাখেন সুমাইয়া। বেদেনা বেগম, বয়স ২৪/২৫ হবে বলে ধারণা করেন। তিনিও ১০ বছর আগে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন।
তিনি বলেন, বাল্যবিয়ের পেছনে আরো কয়েকটি কারণ আছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, ঘটকরা অল্প বয়সী মেয়ে খোঁজেন, এদের নাকি বিয়ে দেওয়া সহজ। বরপক্ষ অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করতে বেশি আগ্রহী। বয়সটা ১৫/১৬ হলে নাকি ভালো হয়।
খলিল মণ্ডলের হাটে গিয়ে ওই গ্রামে বাল্যবিয়ের প্রবণতা জানতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, কাজী সাহেবও এখন কৌশল অবলম্বন করেন। আগে-ভাগেই দুই পরিবারকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বয়সের সনদ এনে রাখতে বলেন। না হলে বিয়ে হবে না। তাই বয়স যাই হোক আইন অনুযায়ী ছেলে-মেয়েদের বয়সের সনদ যোগাড় রাখেন পরিবার।
চোখ বুজে সনদ দেয় ইউনিয়ন পরিষদও। ভোটারের সঙ্গে যেন কোনো সম্পর্ক খারাপ না হয়। ভোটারকে এ অন্যায় কাজে সহায়তা করে পরবর্তী নির্বাচনের ভোটটিও আদায় করে রাখেন মেম্বার ও চেয়ারম্যান!

তার দাবি, কাজীরা সনদ আনার পরামর্শ এখন আর দেন না। যারা বিয়ে দেন তারা আগে থেকেই বয়সের সনদ যোগাড় করে রাখেন। এটা কাজীর আগে ঘটক সাহেবই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাহায্য করেন।
তিনি বলেন, প্রাপ্ত বয়স হয়েছে কি-না তা খুব ভালোভাবে যাচাই করার সুযোগ আমরা পাই না। তবে বর-কনের পরিবার যদি সনদ নিয়ে বসে থাকে, তাতে বিয়ে পড়াতেও অনেক সময় বাধ্য হই। তাই সবার আগে ভুয়া সনদ বন্ধ করতে হবে। এটা বন্ধ করা গেলে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা অনেকটা সহজতর হবে।
চরমাধবদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তুহিনুর রহমান মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, সনদ দেওয়ার দায়িত্বে যিনি থাকেন তাকে ভুল-ভাল বুঝিয়ে বর-কনের পরিবার এ ধরনের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এটা জানতে পেরে গত কয়েক মাস হলো আমি সনদ দেওয়ার ব্যাপারে খুব কঠোর অবস্থানে আছি। তখন থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েকে সাথে নিয়ে না আসলে তাকে আর সনদ দেওয়া হচ্ছে না।
তিনি বলেন, বাল্যবিয়ে সমাজের জন্য একটি অভিশাপ। চরাঞ্চলে দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় বাল্যবিয়ে অনেক বেশি হয়েছে। তবে এখন থেকে এটা কমে আসবে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বাল্যবিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৫
আরকেবি/এএসআর