জনতা মগ্ন কবিগানে। গেরুয়া পোশাক পরে একজন বাউলশিল্পীর বেশে গান পরিবেশে করছেন তালে তালে।
এক একটা কথা-ছন্দ যেন সুস্থ জীবনের এক সচেতনতামূলক বাণী। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধের সচেতনতা বিষয়ে নানা বার্তা দেয়া হচ্ছে। এই বাউলশিল্পী আর কেউ নন। তিনি মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহমুদুর রশিদ। ডা. মাহমুদুর রশিদ মনপুরায় আসেন ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
তারপর থেকেই হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামেন তিনি। নিয়েছেন নানা ধরনের পদক্ষেপ। এ নিয়ে রোগীদেরকে যেমন সচেতন করতেন, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গেও বৈঠক করতেন। মানুষ যাতে করে নানা রোগের বিষয়ে আগে থেকে সচেতন হয় সেই জন্যই কবিগান পরিবেশন করছেন। সারাদিন হাসপাতালে দায়িত্বপালন করে রাতে বাউলগান করছেন।
বছরে চার থেকে পাঁচবার তিনি এই কবি অথবা বাউলগানের অনুষ্ঠান করেন সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততায়।
মনপুরা হাসপাতালের জন্য এক নিবেদিতপ্রাণ মানুষ তিনি। কোনো ধরনের সরকারি ছুটি পালন থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন। এমনকি নিজের পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। পুরো পরিবার থাকে ঢাকায়। তিনি একা পড়ে আছেন অন্ধকার দ্বীপ মনপুরাতে। প্রসূতি মায়েদের সেবায় সদা নিয়োজিত ডাঃ মাহমুদুর।
২০১৭ সালে মনপুরা দ্বীপের জান্নাত, রুনা, তাহমিনা, রাবেয়া, ইয়াছনুর মারা যান। মূলত অদক্ষ দাইয়ের (ধাত্রীর) মাধ্যমে ডেলিভারি করানোর ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে এরা মারা যান। সেই ছবি টানানো হয়েছে হাসপাতালের দেয়ালে। কেউ যেন আর অদক্ষ দাই দিয়ে ডেলিভারি না করান, সেই বিষয়ে চালানো হয় প্রচার প্রচারণা।
নিজের পকেট থেকে ৯ জন মাঠকর্মীকে টাকা দেন তিনি। যাতে করে মোবাইল ফোনে ডেলিভারির জন্য অপেক্ষমান মায়েদের খোঁজ নেয়া যায়। তাদের সাধারণ চেকআপ করানো হয়। বর্তমানে মনপুরা দ্বীপের এক বিবাহিত ব্যাচেলর ডা. মাহমুদুর রশিদ।
মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চারজন ডাক্তার, ছয় জন নার্স ও একজন ওয়ার্ডবয় চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। নিজেও ছুটি নেন না; এমনকি বেশিরভাগ সময় পড়ে থাকতে হয় হাসপাতালে।
চিকিৎসাসেবা দেয়া প্রসঙ্গে ডাঃ মাহমুদুর রশিদ বলেন, সেবাই ধর্ম। মানুষের সেবা করে আমি শান্তি পাই। অবহেলিত মানুষের মনে থাকা মানেই আমার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানে থাকা। মানুষকে সেবা দিয়ে আমি শান্তি পেয়ে থাকি। এখানে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে সব শ্রেণির মানুষকে এক করেছি। সবাই এখন হাসপাতালের সার্বিক উন্নয়নে এগিয়ে এসেছে। যারা হাসপাতালে ভালো কাজ করে প্রতিবছর তাদের পুরস্কার দিয়ে থাকি।
পরিবার পরিজন প্রসঙ্গে ডাঃ রশিদ বলেন, আপনি বলতে পারেন আমি এক বিবাহিত ব্যাচেলর। এখানে একা থাকি মানুষের সেবা দিয়ে থাকি। দুস্থদের পাশে থাকা মানেই শান্তিতে থাকা। দুই বছর আগে সাধারণ মানুষ মনপুরা হাসপাতালে আসতো না এখন বছরে প্রায় ২৯ হাজার ডেলিভারি করানো হয়। মা ও শিশুকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। ’
তিনি সরকারের কাছে দাবি রেখে বলেন, মনপুরায় এক লাখের উপরে মানুষ বসবাস করেন। প্রতিবছরে ২৯ হাজার মায়ের ডেলিভারি করানো হয়। ডেলিভারি রোগিদের সকল ধরনের সেবা দেয়ার জন্য সরকার যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। আল্ট্রা সনোগ্রাফিসহ চিকিৎসা সরঞ্জামাদি যেন সরবরাহ করা হয়। কারণ দুর্গম এলাকায় অনেক সময় প্রসূতি মারা যায়। জটিল বিষয়ে চিকিৎসা দেয়ার কোনো যন্ত্রপাতি
আমাদের কাছে নেই।
মনপুরা দ্বীপে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত একটা পর্যন্ত শুধু বিদ্যুৎ থাকে। তাই জেনারেটর ও সৌরশক্তির মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছেন ডাঃ মাহমুদুর। এছাড়া যেসব প্রসূতির এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব হয় না, উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল থেকে তাদের অনুদান দেয়া হয়। এসব অনুদান সরকারের নয়, সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে তাদের মাধ্যমে ফান্ড জোগাড় করেছেন মাহমুদুর রহমান।
বাংলাদেশ সময়:১২৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৮
এমআইএস/ জেএম