ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

শিক্ষার আলো-বঞ্চিত জেলে পল্লির শিশুরা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১৮
শিক্ষার আলো-বঞ্চিত জেলে পল্লির শিশুরা খেলায় মত্ত জেলে পল্লির শিশুরা। ছবি: বাংলানিউজ

সুন্দরবনের জয়মনির ঠোটার জেলে পল্লি ঘুরে: সন্ধ্যার সংকেত চারদিকে। ধীরে ধীরে ডুব দিচ্ছে লাল সূর্যটা। শ্যালা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে যত দূর চোখ যায় অথৈই পানি। দূর থেকে দুই একটা নৌকা আসছে জেলে পল্লির দিকে। এর মধ্যে মসজিদ থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে কানে। সন্ধ্যা নেমে এলেও জেলে পল্লির শিশুরা ঘরে ফিরছে না। দূরন্তপনার রেশ কাটছে না তাদের। শৈশব-কৈশোরের আনন্দে উল্লাসে মত্ত তারা। 

সম্প্রতি সুন্দরবনের জয়মনির ঠোটার জেলে পল্লিতে সরেজমিনে দেখা যায়, লেখা পড়ার ইচ্ছা থাকলেও সে সুযোগ নেই সেখানকার শিশুদের। নানা সংকটে কাটছে তাদের শৈশব।

এখানে শৈশবের ডানা মুখ থুবড়ে মরছে অপুষ্টি আর অশিক্ষায়। শৈশব কাটতে না কাটতেই কর্মজীবনের সূচনা। কাঁধে ভর করে সংসারের বোঝা। উপকূলের প্রান্তিক জনপদের এসব শিশুদের চোখ শুধুই রোজগারের পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে। মাত্র আট থেকে নয় বছর বয়সেই জেলে পল্লির অনেক শিশুই দক্ষ মাঝি ও জেলে হয়ে গেছে।  

জেলে পল্লির একাধিক শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইচ্ছা থাকলেও স্কুল না থাকায় এখন কেউ পড়াশুনা করতে পারছে না। এই পল্লির কেউ কেউ হয়তো প্রথম কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে, এরপর কাজে নামতে হয়েছে। আর সে কাজটা হচ্ছে মাছ ও কাঁকড়া ধরা।  

খেলায় মত্ত নয় বছর বয়সী আলাউদ্দিন বলে, আমাগো স্কুল ঝড়ে ভাইঙ্গে (ভেঙে) গেছে। আর হেই (সেই) থেকে আমরা পড়ালেহা (পড়ালেখা) করি না।  জেলে পল্লির এক শিশু।  ছবি: বাংলানিউজ১০ বছর বয়সী সিয়াম বলে, ইচ্ছা ছিল স্কুলে যামু (যাবো)। ভর্তি হমু (হবো), স্কুল নাই তাই ভর্তি হইতে পারি নাই।

রবিউল নামের অপর এক শিশু বলে, আমাগে (আমাদের) পড়ালেহা (পড়ালেখা) অয় (হয়) না। আব্বার লগে মাছ কাড়া (কাঁকড়া) ধরি।  

কিশোর আহাত মাতব্বর বলে, স্কুল আছে অনেক দূর। সময় নেই অত (এতো) দূর স্কুলে যাওয়ার।  

জেলে পল্লির জেলে সোহেল রানা বলেন, দুই কিলোমিটার দূরে জয়মনির বাজারের স্কুলে পোলাপান যাইতে চায় না। আমাগে (আমাদের) এহানে (এখানে) একটা স্কুল ছিল ঝড়ে ভেঙে যাওয়ার পর আর তৈরি হয়নি। যার কারণে জেলে পল্লির পোলাপানের লেহাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। জেলে পল্লির শিশুরা।  ছবি: বাংলানিউজজেলে পল্লির বেশ কয়েকজন অভিভাবক বলেন, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ আমরা। মাছ না পেলে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। নদীতে না গেলে তো জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। স্কুল থাকলেও আমাদের লাভ নেই। লেখাপড়া করানোর সামর্থ্য নেই। পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য আমাদের শিশুদের অল্প বয়সেই কাজে নামাতে হয়। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় আমাদের।

জয়মনির ঠোটা জামে মসজিদের ইমাম মো. ইমাম হোসেন গাজী বাংলানিউজকে বলেন, আশপাশে এক-দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোথাও স্কুল নাই। যে কারণে এ পল্লির ছেলে মেয়েরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এখানে একটা এনজিওর স্কুল ছিল। সাত-আট মাস আগে ঝড়ে তা ভেঙে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে শত শত ছেলে মেয়ের লেখা পড়া।  

ইমাম হোসেন আরও বলেন, স্কুল ভেঙে যাওয়ার পরে আমি মকতবে পড়াতাম। কিন্তু কেউ বেতন কড়ি না দেওয়া আমি পড়ানো বাদ দিয়েছি। বাড়ির আঙ্গিনায়  জেলে পল্লির চার শিশু।  ছবি: বাংলানিউজচিলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আকবর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন,  সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা মোংলার শ্যালা নদীর পাড়ের জয়মনির ঠোটায় জেলেরা বসবাস করেন। ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ডের পুরাটাই জেলে পল্লি। সুন্দরবন এলাকার নদী ও খালগুলোতে মাছ, পোনা ও কাঁকড়া ধরে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। যেখানে নদীর পাড়ে প্রায় পাঁচ হাজার হত দরিদ্র জেলেরা বাস করেন। এসব দরিদ্র জেলেদের ছেলে মেয়েদের জন্য জয়মনির ঠোটায় একটি স্কুল ছিল। স্কুলটি ঝড়ে ভেঙে যাওয়ায় ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ওই স্কুলে রীনা নামে এসএসসি পাস এক তরুণী অসহায় ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া শেখাতেন। এ শিক্ষিকার নিজের সন্তান না থাকায় জেলে পল্লির ছেলে মেয়েদের কাঁদা-পানি থেকে উঠিয়ে এনে পড়াতেন।

আকবর আরও জানান, স্কুলটি আবারও নির্মাণ করা হবে। সে জন্য দুই বান টিন ও ছয় হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কোনো স্থান থেকে আরও বরাদ্দ আনা যায় কিনা তার চেষ্টা করা হচ্ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৬ ঘণ্টা,  অক্টোবর ০৫, ২০১৮
এমআরএম/আরআইএস/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।