ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের মানুষের পাশে টাইগার শোয়েব

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২০
উপকূলের মানুষের পাশে টাইগার শোয়েব উপকূলের মানুষের পাশে টাইগার শোয়েব

সাতক্ষীরা: বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের আইকনিক সাপোর্টার শোয়েব আলী। সবাই তাকে চেনেন টাইগার শোয়েব নামে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের উৎসাহ দিতে বাঘ সেজে স্টেডিয়াম মাতানো টাইগার শোয়েবকে দেখে অনেকেই ভাবতে পারেন তিনি শুধু আনন্দ আর উল্লাসেই মেতে থাকেন।

কিন্তু না, দেশের যেকোন ক্রান্তিলগ্নে নিজের সর্বস্ব দিয়ে মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন পেশায় মোটর মেকানিক টাইগার শোয়েব।

শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্য যে, মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরা ও খুলনার উপকূলীয় এলাকার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চার মাসেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন টাইগার শোয়েব।

সাধ্যমত সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে। সেই করোনার প্রাদুর্ভাব থেকে শুরু, এখনো শোয়েব রয়েছেন সাতক্ষীরা ও খুলনা উপকূলে।

সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে টাইগার শোয়েব পারি দিয়েছেন দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৫ হাজার কিলোমিটার পথ। খাদ্য সহযোগিতা পৌঁছে দিয়েছেন ৩০ হাজার মানুষের কাছে।

টাইগার শোয়েব বলেন, আমি পেশায় মোটর মেকানিক। আমার একটা গাড়িও আছে। আমি ঢাকায় রাইড শেয়ারিংয়ে নিবন্ধন করে গাড়ি চালাতাম। প্রথমে আমার এমন কোনো প্ল্যান ছিল না। করোনার শুরুতে সবকিছু যখন বন্ধ হয়ে গেছিল, তখন মানুষের খাদ্যের অভাব দেখে খুব কষ্ট পাইছি। তখনই মূলত যতটুকু পারছি, মানুষকে খাদ্য দিয়ে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। এরপর রোজার ঈদের মাত্র দুই তিন দিন আগে খুলনা, সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। আমি ঈদের পরদিনই শ্যামনগরে চলে আসি।  

তিনি আরও বলেন, এখানে না এলে জানতে পারতাম না বাংলাদেশে এতো অবহেলিত এলাকা আছে। এখানকার মানুষের আয় মাছ ধরে, সুন্দরবনে মধু কেটে- এগুলো আগে লোকের মুখে শুনতাম। বিশেষ করে নারীরা অভাবের তাড়নায় নদীতে জাল টেনে মাছ ধরে। এখানে ঘূর্ণিঝড়ে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার দুই ভাগও পত্রপত্রিকায়, টিভিতে আসেনি। গত চার মাস এখানে আছি, আমি কোনো পরিবর্তন দেখতেছি না। আমি আসলে মানুষের কষ্ট দেখে এখান থেকে যেতে পারতেছি না। যতক্ষণ একজন মানুষের খাবার আমার কাছে আছে ততক্ষণ আমি এখান থেকে যাব না।

টাইগার শোয়েব বলেন, আমি প্রথমে দুইশ জনের খাবার ও কিছু টাকা নিয়ে আসি। আর এ পর্যন্ত ৩০ হাজার মানুষকে খাদ্য সহযোগিতা দিতে পারছি। এটা যে সব আমি দেই তা নয়। জাতীয় ক্রিকেট দলের কয়েকজন খেলোয়াড়, ক্রিকেট বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ নাম না জানা দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ আমার কাছে সাহায্য সহযোগিতা পাঠায়। আমি নিজ হাতে মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেই। আমি অনেককে জিজ্ঞাসা করছি, আপনারা সর্বশেষ গরুর মাংস কবে খেয়েছেন- বেশির ভাগ মানুষ বলে আমরা কোরবানির ঈদে একটু গোশত পাই, তাই খায়। তাও মাথাপিছু এক দেড়শ গ্রাম করে। আসলে এখানকার মানুষের আয় খুবই কম। জাল টেনে ৭০-৮০ বা ১০০ টাকা পায়। এতে তো চলা সম্ভব না।

এজন্য কোরবানির ঈদে ছয়টি গরু ও একটি ছাগল কোরবানি করেছিলাম এখানে। কোরবানি করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে গোশত পৌঁছে দিয়েছি বলে যোগ করেন তিনি।

দীর্ঘ চার মাস ধরে সাতক্ষীরা ও খুলনা উপকূলে আছেন, কোনো সমস্যা হচ্ছে না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, লবণ পানিতে অ্যাডজাস্ট করাটা খুব কঠিন। আমি তো কালো হয়ে গেছি। চুলকানি হয়। অনেকেই বলে বহুত করছো, এবার চলে আস। কিন্তু দিন শেষে মানুষের মুখে হাসি দেখতেই ভাল লাগে।

টাইগার শোয়েব বলেন, সবার একটা নিরাপত্তা থাকে। কিন্তু শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, মুন্সীগঞ্জ, বুড়িগোয়ালিনী, আশাশুনির প্রতাপনগর, শ্রীউলা ও খুলনার কয়রার মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। এখানে এখনো মানুষের ঘরে পানি। থাকার জায়গা নেই। খাবার পানি নেই। পায়খানা নেই। রান্না করার জায়গা নেই। সবকিছু মিলে মানুষের দুর্বিষহ জীবন। মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে, বেড়িবাঁধে আছে। কয়দিন থাকা যায় এমন করে।

ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত টাইগার শোয়েবকে বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এখন ব্যাচেলর আছি, ভাল। যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি। বিয়ে করলে তো আটকে যেতে হবে। এজন্য ভাবি না। আসলে মানুষের বিপদে আপদে পাশে থাকতেই আমার ভাল লাগে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২০
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।