ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

ভয়াল ১২ নভেম্বর

‘অনেক লাশ নিজেই ভাসিয়ে দিয়েছি’

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২২
‘অনেক লাশ নিজেই ভাসিয়ে দিয়েছি’

বলেশ্বর নদ পাড় ঘুরে: ১৯৭০ সাল একটি ইতিহাসের বছর। এ সালের ১২ নভেম্বর বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, সাতীরা ও পিরোজপুরসহ উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে বয়ে গিয়েছিল ভয়াল সাইক্লোন।

এতে লক্ষাধিক মানুষ ও গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে। সেসঙ্গে এর তাণ্ডবলীলায় তছনছ হয়ে যায় উপকূলীয় অঞ্চলের বাড়িঘর ও গাছপালা। আর তা থেকে রেহাই পায়নি উপকূলীয় অঞ্চল বরগুনার পাথরঘাটাও।

আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর। উপকূলবাসীর বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের দিন। এ দিনে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব নিঃস্ব করে দেয় পুরো জনপদ। হারিয়ে যায় লক্ষাধিক প্রাণ। নিখোঁজ হয় অসংখ্য মানুষ। আজও স্বজনহারা মানুষদের তাড়া করে বেড়ায় বিভীষিকাময় সেই স্মৃতি। সত্তর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এটি ইতিহাস।

সেই স্মৃতির কথা শুনতে গিয়েছিলেন বাংলানিউজের প্রতিবেদক। বলেশ্বর নদ পাড়ের পদ্মা গ্রামে। বিস্তৃর্ণ এ গ্রামে প্রতিনিয়তই ঘূর্ণিঝড়ের থাবায় তছনছ হয়ে যায়। প্রকৃতিই যেন এ অঞ্চলের মানুষের প্রতি বিরুপ আচরণ করছে। তারপরেও প্রকৃতির দয়ায়ও বেঁচে থাকেন এখানকার মানুষ।  

কথা হয় সেই ভয়াল ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় কাছ থেকে দেখা প্রবীণ বাসিন্দা হাজী আ. কাদের। সেই ভয়াল স্মৃতির কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, আরে বাবা সে তো কিছুদিন আগের কথা; আমরা চোখে দেখেছি সেই ৭০ এর পানির তাণ্ডব। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যায়। বিষখালী নদী থেকে এসে দেখি শুধু লাশ আর লাশ। লাশ দাফনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় নিজের হাতে অনেক লাশ ভাসিয়ে দিয়েছি।  

তিনি আরও বলেন, বন্যার পর অনেক মানুষ আমাদের বাড়িতে অভাবের তাড়নায় ভাতের মার নিয়ে খেয়েছেনে দিনের পর দিন।



পাথরঘাটা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সিরাজুল হক মোল্যা সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি তুলে ধরে বলেন, তখন ছিলাম যুবক। গায়ে ছিল অনেক শক্তি। আমার বয়সে এমন বন্যা দেখিনি। মুহূর্তের মধ্যে পানি এসে সব তলিয়ে যায়। অনেক লাশ ভেসে যায়। অনেকের খোঁজও মেলেনি। গাছের আগায় লাশ দেখা যায়। অনেক ঘরবাড়ি ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। ঘর চাপা পড়ে অনেক মানুষও মারা যায়। তবে পানি কম সময় ছিল। বেশি সময় থাকলে পাথরঘাটার চি‎হ্ন থাকতো না। বিভীষিকাময় সেই স্মৃতি এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।  

গহরপুর গ্রামের ইদ্রিস আলী খান বলেন, আমরা চোখে দেখেছি সেই পানির তাণ্ডব। আমরা ৭ ভাই-বোন ছিলাম। সংসারের আমি বড়। পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে ছোট দুই ভাইকে নিয়ে পাশেই ওয়াপদা ভবনের ওপরে দিয়ে আসার পর, বাকিদের আনার জন্য বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারিনি। এর আগেই পানিতে সব তলিয়ে গিয়েছিল।

বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়টি পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঝড় হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। চলতি বছরের ১৮ মে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতী আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকা প্রকাশ করে।

তালিকার শীর্ষ প্রাণঘাতী ঘটনা হিসেবে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ ঝড়টিকে পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এতে বলা হয়, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে সর্বকালের ভয়াবহ প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে। সরকারি হিসেবে এতে তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষ মারা যান। তবে বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি ছিল।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ‘৭০- এর আগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বাকেরগঞ্জ সাইকোন’-এ প্রায় ২ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এরমধ্যে এক লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জ তথা বর্তমান বরিশাল অঞ্চলে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানা যায়। ওই ঘূর্ণিঝড়েও ২ লাখ লোক প্রাণ হারান।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২২
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।