২০০৭ সালের বিশ্বকাপের কথা। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিশ্বকাপের আসর বসার গোড়ার দিকেই ভারত বাদ পড়ে যায়।
গ্রুপ পর্বেই ভারত যখন বাদ পড়লো, ক্রিকেট ঘিরে যে শত কোটি ডলারের চালাচালি শুরু হয়েছিলো তা বন্ধ হয়ে গেলো। বিশ্বের অধিকাংশ ক্রিকেট ভক্ত তাদের টেলিভিশন সেট বন্ধ করে দিলো। খেলায় আর আগ্রহ নেই। আর ফলে ভারতের সম্প্রচার বাণিজ্যের আকাশে নেমে এলো কালো মেঘের ছায়া। তাদের কোটি কোটি ডলারের বাণিজ্য বন্ধ। কারণ বিজ্ঞাপন বন্ধ, আর তার হাত ধরে আয়ও বন্ধ।
এ কারণে ঝামেলায় পড়ে গেলেন ভারতীয় রাজনীতিক আর ব্যবসায়ীরা। বিশ্বের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম খেলার মোটাভাগ যাদের হাতের কব্জায়। তা কেবল ভারতেই নয়, বিশ্বের দেশে দেশে ক্রিকেটে তাদেরই লগ্নি করা রয়েছে কোটি কোটি ডলার।
এরপর শুরু হলো নতুন খেলা। এই খেলা মাঠের বাইরের। এমন বিপর্যয় যেনো ক্রিকেটের অর্থনীতিতে আর নেমে না আসে সে জন্যই খেলা উঠলো টেবিলে।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের এখনকার নকশার দিকে তাকালে সেটাই দেখা যাবে। এই ছক এমনভাবে কাটা হয়েছে যাতে বড় বড় শক্তিগুলো, বিশেষ করে ভারতীয় দল যাতে ক্রিকেটের শেষ পর্যায় পর্যন্ত টিকে থাকে।
এ যেনো কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত। মানে বিশ্বকাপের আসর বসিয়ে ভারতকে বাদ দিও না, তাতেই ক্রিকেটের অর্থনীতি টিকে থাকবে।
যতদিন ভারত আছে, খোলা আছে কোটি কোটি টেলিভিশন সেট। তাতে খেলা চলে, ক্রিকেট চলে, ছক্কা-চারের মার চলে, কট আউট বোল্ড আউট চলে, এলবিডব্লিউর নামে রিপ্লে চলে, থার্ড আম্পায়ারের ‘ডিসিশন পেন্ডিং’ চলে। আর এরই মধ্যে ক্রিকেটের পরতে পরতে ঢুকে পড়ে স্পন্সরশিপ।
খেলোয়াড়ের চার-ছক্কা, হাফ-সেঞ্চুরি, সেঞ্চুরির ওপর লগ্নি হয়ে যায় বুকিদের কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে ক্রিকেট হয়ে থাকে টাকার খেলা।
ভারতের ক্রিকেট ফ্যানরা তাদের হিরোদের হিরোগিরি দেখতে চায়। তাদের দেখতে চায় ক্রিকেটের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। ২০১১ সালেই ঠিক ঠিক চ্যাম্পিয়ন ভারত। কোনও কথা বলা যাবে না, ছোঁড়াও যাবে না সন্দেহের তীর। কারণ যুক্তিটা খাড়া আছে, ভারতের মাটিতেই যে আয়োজন, ভারততো চ্যাম্পিয়ন হবেই।
এবারের ক্রিকেটের গোড়াতেই ভারত দাপট দেখিয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়ে তারা যোগ্যতার সাক্ষর রাখলেও দলকে কিন্তু খুব একটা শক্ত দল বলে এক কথায় তকমা এঁটে দেওয়া যাবে না।
১৪ টিমের বিশ্বকাপ আসর। সাতটি করে দল ভাগ হয়ে পুল-এ, পুল-বি হয়ে গ্রুপ পর্বের খেলা। প্রতিটি পুলে প্রথম সারির চার দল আর তিনটি করে দ্বিতীয় টায়ারের ক্রিকেট দলকে স্থান দেওয়া হয়েছে। প্রথম ৪২টি ম্যাচ হলো গ্রুপ পর্বে। তবে খেলা জমে ওঠে কোয়ার্টার ফাইনালে এসে।
সাধারণ চেহারাটি হচ্ছে প্রধান সারির আটটি দেশই কোয়ার্টার ফাইনালের লড়াইয়ে মাঠে থাকে। বাকিরা কেউ মাঠের দর্শক হয়, কেউ বা ফিরতি ফ্লাইট চেপে দেশে ফেরে।
ছক কাটাই ছিলো। কিন্তু এবার ঘটে যায় কিছুটা বিপত্তি। ক্রিকেট পরাশক্তির অন্যতম আর ক্রিকেটে সুতিকাগার ইংলিশ দলকে এবার গ্রুপ পর্বেই ক্রিকেট থেকে ছিটকে দেয় বাংলাদেশ। ফলে শেষ আটে স্থান করে নেন মাশরাফিরা, সে কথা নতুন করে বলার কিছু নেই।
সে পর্যন্তও কোনও সমস্যা ছিলো না, কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের সঙ্গেই পড়ে যায় বাংলাদেশের ম্যাচ। এবার বাংলাদেশ যে ফর্মে তা মেনে নিতে ক্রিকেট বিশ্বের কেউ নারাজ হবেন না, সে কথা হলফ করে বলা যায়। তাই শুরু থেকেই বলা হচ্ছিলো, ভারতকে সমীহ করতে হবে বাংলাদেশকে।
কিন্তু সমীহ করেই যদি শেষ হতো, সে করে যদি খেলার মাঠে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করেই জিতে যেতো ক্ষতি-বৃদ্ধি কিছু ছিলো না। কিন্তু বাংলাদেশের হার নিশ্চিত করতে খেলতে হলো মাঠের বাইরেও। এ কথা মেনে নেবেন ক্রিকেট বোদ্ধারাও।
হ্যাঁ কোর্য়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ হেরেছে। কিন্তু তার জন্য আম্পায়ারদের তিনটি পক্ষপাতিত্বমূলক সিদ্ধান্ত দিতে হয়েছে। সে পক্ষপাতিত্ব ভারতেরই স্বার্থে। ভারতকে যে টিকিয়ে রাখতে হবে। তাতেই যে টিকে থাকবে ক্রিকেটের অর্থনীতি।
খেলার সঙ্গে যদি অর্থনীতি জড়িয়েই থাকে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে যদি সে জন্য নিজের কব্জায় রাখতেই হয় তো, নিজেদেরই যোগ্যতা কেনো আরও বাড়াও না।
আমরা যদি ক্রিকেটের অর্থনীতিটা একটু বোঝার চেষ্টা করি তাহলে ব্যাখ্যাটি এরকম- গোটা ভারতের ১২০ কোটি মানুষের মধ্যে ক্রিকেট তো ভালোই জনপ্রিয়। জরিপের ফলগুলো বলেছে ২৫ বছরের নিচের বয়সি ৮০ শতাংশ ভারতীয়ই ক্রিকেটভক্ত। আসল চিত্র হয়তো তার চেয়েও বেশি।
অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডের কথাই ধরি। এদেশের লোক সংখ্যা মোটে ৪০ লাখ। যাদের অধিকাংশই আবার ক্রিকেট নয় ভালোবাসে রাগবি খেলা। ফলে ওদের দেশে ক্রিকেট দিয়ে আয় করে নেওয়া দুষ্কর।
কিন্তু আমরা যদি বাংলাদেশের কথা ধরি। এদেশেরও কিন্তু ১৬ কোটি মানুষ। আর বলা হয়, বাংলাদেশ দল যখন খেলে তখন গোটা দেশে খেলে, খেলে ১৬ কোটি প্রাণ। আর এখানেও ক্রিকেটের অর্থনীতিটা খুব ছোট নয়। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার চেয়েতো বড়ই।
বাংলাদেশ সময় ১৫১৬ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৫