অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে: ভদলোকের ‘ডিএনএ’ টেস্টে নাকি ডিফেন্স বলে কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না! এমসিজিতে শুক্রবার নিউজিল্যান্ড দলের প্র্যাকটিস দেখতে দেখতে নিউজিল্যান্ড রেডিওর সাংবাদিক পিটার হাওর্য়াথের কথাটাই বার বার মনে পড়ছিল। আসলে ব্র্যান্ডন ম্যাককালাম আক্রমণ ছাড়া অন্য কিছু বোঝেন না! বুঝলে প্র্যাকটিসে নেট বোলারদের উপর ওরকম নির্দয়ভাবে চড়াও হবেন কেন? এই কেন-র কোনো উত্তর নেই।
একটু ভুল বলা হলো! ব্র্যান্ডন ‘ব্রিলিয়ান্ট’ ম্যককালাম। এবং তার ব্রিলিয়ান্ট ক্যাপ্টেন্সিতে বিশ্বকাপের ফাইনালে নিউজিল্যান্ড। সেটা মানছেন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট মহল। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরাও। আর মানবেন না কেন। ছ’বার সেমিফাইনালে খেললেও যে দলটা ফাইনাল খেলতে পারেনি এর আগে, সেই দলটাকে এবার ফাইনালে নিয়ে এসেছেন ম্যাককালাম। ক্রিকেট বিশ্ব যে কারণে এখন বলছে; পারলে এই দলটাই পারবে নিউজিল্যান্ডকে বিশ্বকাপ জেতাতে।
কিন্তু মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া একটু অন্যরকম কিছু ভাবছে। ভারতকে বাড়ি পাঠানোর পর অস্ট্রেলিয়ার এখন ভাবনা বলতে নিউজিল্যান্ডের গা থেকে ‘অপরাজিত’ সাইনবোর্ডটা নামিয়ে ফেলা। আর সেটা পারলে মাইকেল ক্লার্কের হাতে বিশ্বকাপ। এমসিজিতে ইমরান খানের পর বিশ্বকাপ হাতে ছবিটা তুলতে পারবেন ক্লার্ক। কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালের আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে এমসিজি যে রীতিমতো কিউইদের দখলে! মাঠে ব্র্যান্ডন মাককালামরা। প্রেসবক্সে নিউজিল্যান্ড মিডিয়া। আর এমসিজি পর্যটনে এসে যারা টিকিট কেটে ঘুরে ঘুরে এমসিজির ইতিহাস, ঐতিহ্য, আকৃতি, বিশালত্ব দেখছেন আর খানিকটা বিস্মিত হচ্ছেন তারাও কিউই! তাসমান সাগর পেরিয়ে এসেছেন রোববারের ফাইনাল দেখতে। আর এই ফাইনালটার গায়ে নানা রকম স্টিকার লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে। কেউ বলছেন, ‘ব্যাটেল অব তাসমান’। কেউ বলছেন ‘বড়ভাই-ছোট ভাই’র ম্যাচ! কেউ বলছেন ‘দুই স্বাগতিক দেশের লড়াই’!
ফেসবুকে আবার দু’একজন ভারতীয় স্ট্যাটাস দিয়েছেন; ফাইনালটা ওরা ওরা যদি খেলবে, তাহলে বাকিদের ডেকে আনার কি দরকার ছিল!’ আসলে মানুষের স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল! চার বছর আগে ওয়াংখেড়ের ফাইনালে ভারত যখন শ্রীলংকার বিপক্ষে খেলেছিল, তখন কি মনে হয়েছিল, ওরা ওরা মানে দুই আয়োজক দেশ যদি ফাইনাল খেলবে তাহলে বাকিদের ডেকে আনার দরকার কি ছিল! আসলে সবাই ব্র্যান্ডন ম্যাককালামের মতো আক্রমণাত্মক হতে চান। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে। অনেকের জানা থাকে না আক্রমণের উল্টোপিঠে প্রতিআক্রমণ বলে আরেকটা শব্দ আছে।
তবে প্রতিআক্রমণ নয়। ‘প্রতিশোধ’ শব্দটাই ঘুরপাক খাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট মহলে। বিশ্বকাপের গ্রুপ ম্যাচে অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে শ্বাসরুদ্ধকর এক ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে ১ উইকেটে হেরেছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই হারের ক্ষতটা এখনো শুকায়নি তাদের। বিশ্বকাপ জিতলেই শুধু সেই খতের উপর প্রলেপ পড়তে পারে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক পুরনো ও গভীর ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে নিউজিল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়া কোনো দিনই নিউজিল্যান্ডকে পাত্তা দেয়নি। খানিকটা বড়ভাই সুলভ মানসিকতা। আর সেই ইতিহাসটা অনেক পুরনো। নিউজিল্যান্ড টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার আগে একটা টেস্ট খেলেছিল অস্ট্রেলিয়া। এবং যথারীতি জিতেছিল। তারপর থেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিলো ছাড়া তেমন কিছু পায়নি কিউইরা অজিদের কাছ খেকে। এবং সেটা এমন পর্যায়ে ছিল যে নিউজিল্যান্ড টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর ছাব্বিশ বছর পর্যন্ত তাদের সঙ্গে একটা টেস্ট খেলেনি অস্ট্রেলিয়া! ওদের সঙ্গে কি টেস্ট খেলবো! ওরাতো হারে!
এরকম নাক উঁচু ভাব নিয়ে সময় পার করেছে অস্ট্রেলিয়া। সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়া না খেললেও তাদের পূর্ব পুরুষদের দল ইংল্যান্ড অবশ্য ১১টা টেস্ট খেলেছিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিল ব্রাউন অস্ট্রেলিয়া দলের নেতৃত্ব নেওয়ার পর থেকে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ানদের এক তরফা দাপট শুরু। মাঝখানে রিচার্ড হ্যাডলি নামের এক ভদ্রলোক অজিদের সেই দাপট কিছুটা খর্ব করেছিলেন আশির দশকের মাঝামাঝি। তারপর আবার সেই দাপট অব্যাহত। কিন্তু বিশ্বকাপের ফাইনালে এই প্রথম মুখোমুখি হতে যাচ্ছে দুই পড়শি দেশ।
ম্যাককালাম ও তার দলের সামনে সুযোগ বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের। নিউজিল্যান্ডের এখনো পর্যন্ত আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে বড় সাফল্য বলতে ২০০০ সালে নাইরোবিতে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতা। চ্যাম্পিয়ন শব্দটার সঙ্গে তাদের পরিচিতি বলতে ওটুকই। উল্টো দিকে, চারবার বিশ্বকাপ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। ফাইনাল খেলেছে বহুবার। টানা তিনবারের চ্যাম্পিয়নও তারা। আর এবার ফাইনালটা হচ্ছে সেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। তারপরও কেন বলা হচ্ছে; পারলে এই নিউজিল্যান্ড দলই পারবে।
কারণ, দুর্দান্ত ফর্মে ম্যাককালাম ও তার দল। টানা আট-টা ম্যাচ জিতেছে তারা বিশ্বকাপে। অস্ট্রেলিয়া-সাউথ আফ্রিকা-শ্রীলংকা-ইংল্যান্ড-বাংলাদেশকে হারিয়েছে তারা। যদিও তারা আগের সবগুলো ম্যাচই খেলেছে নিজেদের মাঠে। এমসিজির তুলনায় যে মাঠগুলো একেবারেই পুঁচকে। এমসিজির মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার বিশালত্ব আর বিশ্বকাপ ফাইনালের গুরুত্ব অনুভব করতে চাইলেন মনে হলো ম্যাককালাম আর তার দলের ক্রিকেটাররা।
সংবাদ সম্মেলনে টিম সাউদি যখন এলেন, সেখানে বার বার ঘুরে ফিরে প্রশ্ন উঠলো এমসিজির বিশালত্ব আর মাঠের গ্যালারিতে থাকা দর্শক নিয়ে। নিউজিল্যান্ডের এই ফাস্ট বোলার রীতিমতো ক্লান্তই হয়ে পড়লেন উত্তর দিতে দিতে! শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, আমরা তো এর আগে বিশ্বের বড় বড় অনেক মাঠে খেলেছি। এমসিজিতেও কিউইরা ক্রিকেট খেলেছে। তারপরও এই প্রশ্নটা বার বার বলছেন কেন! আর বিভিন্ন মাঠে প্রচুর সংখ্যক দর্শকের উপস্থিতিতে ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। এসব আমরা কোনো সমস্যা মনে করছি না।
দর্শক সংখ্যাটা কেমন হতে পারে রোববার, সেটা জানার খুব কৌতূহল ছিল। কারণ, এমসিজির আশপাশে ব্লু টি-শার্ট পরা লোকজন যে দেখলাম-ই না! ভারতীয়রা দেশে ফিরে যাচ্ছে তাতে বিশ্বকাপের গুরুত্ব খুব একটা কমে গেলো কি না, আসলে সেটাই জানার খুব আগ্রহ। তা নাহলে ১৯ মার্চ রাতে ক্রিকেটের আইন-কানুনকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে পাকিস্তানি আম্পায়ার আলিম দাররা বাংলাদেশকে বিদায় করার জন্য ওরকম নির্লজ্জভাবে ভারত সমর্থক হয়ে গেলেন কেন! তবে ইয়ারা নদীর তীরে এমসিজির পাশে ওয়ার্ল্ড কাপ ফান জোনে এখনো ওই ম্যাচের কথা লেখা রয়ে গেছে। ১৯ মার্চ, ‘ইন্ডিয়া ভার্সেস বাংলাদেশ’ লেখা অনেকগুলো বোর্ড লাগানো! হয়তো ফাইনালের আগের দিন সেটা তুলে ফেলা হবে। আর যেটা বসানো হবে তাতে লেখা থাকবে ২৯ মার্চ, ‘অস্ট্রেলিয়া ভার্সেস নিউজিল্যান্ড’। আর হ্যাঁ, সেই ম্যাচে এমসিজির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দর্শক আসা করা হচ্ছে। ৯২ হাজার। ‘পুরো মাঠ-ই ভরে যাবে। ’ বললেন ভিক্টোরিয়া ক্রিকেটের সিইও স্টিফেন গফ। সঙ্গে আরো একটান তথ্য জানালেন।
এ পর্যন্ত একদিনে এমসিজিতে সবচেয়ে বেশি দর্শকের উপস্থিতি ছিল ২০১৩ -তে অ্যাশেজ সিরিজে বক্সিং ডে টেস্টের প্রথম দিন। আর সংখ্যাটা? ৯১ হাজার ১শ’ ১২ জন। ভারত না থাকলেও অতীতে দর্শক হয়েছে এমসিজিতে। ভবিষতেও হবে। আসলে আইসিসির ডিএনএ টেস্টে যদি সত্যিই ম্যাককালামের মতো শুধু পজিটিভ জিনিস থাকতো, তাহলে ১৯ মার্চ এমসিজির কোয়ার্টার ফাইনালে আম্পায়াররা একটা দলকে সেমিফাইনালে তোলার এতো চেষ্টা করতেন না!
তাই এমসিজিতে ম্যাককালামের নিউজিল্যান্ড যদি চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় তাহলে বাংলাদেশ অন্যরকম এক সান্ত্বনা পাবে। কারণ, এই নিউজিল্যান্ড দলটার মেরুদণ্ড দিয়ে হ্যামিল্টনে শীতল স্রোত বইয়ে দেয়া দলটার নাম যে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৫
** এসসিজিতে ভারতের হার, এমসিজিতে ট্র্যান্স-তাসমান ব্যাটেল | অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে
** ভারতীয়দের প্রশংসায় অস্ট্রেলিয়া!॥ অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে
** সিডনিই বলে দেবে বিশ্বকাপটা সত্যিই ‘আউট সাইড এশিয়া’ কিনা! | অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে
** মহাতারকাদের ক্রিকেট আড্ডায়ও বাংলাদেশ। । অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে
** আবেগ মেলবোর্নে, যুদ্ধটা সিডনিতে॥ অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে
** তবু ‘চোক’ শব্দটাকে এড়ানো যাচ্ছে না | সিডনি থেকে অঘোর মন্ডল
** জয়ের চেয়ে ভাল প্রস্তুতি আর কি হতে পারতো!| অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে
** বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হ্যাডলিও || অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** মাহমুদুল্লাহর ইনিংস টেনে আনলো মার্টিন ক্রো-কে। । অঘোর মন্ডল, হ্যামিল্টন থেকে
** ক্লাস অব জিরো এইট! || অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** অ্যাডিলেডে শরতের রংও যেন লাল-সবুজ | অঘোর মন্ডল, অ্যাডিলেড থেকে
** ওয়ানডে-তে বোলাররা এখন শ্রমিকের ভূমিকায়! অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** অনেক নাটক জন্ম দিতে পারে ইডেন পার্ক ॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ইয়র্কার এখন বিরল ডেলিভারি!॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** বিশ্বকাপের রান উৎসবে বাংলাদেশও ॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** নেলসনে টাইগারদের তিন ‘ল্যান্ড’ হার্ডল ॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ইংল্যান্ড পারলে বাংলাদেশ কেন নয়? । । অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** শচীন আছেন শচীন নেই! | অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ব্রিলিয়ান্ট! সুপার! গ্রেট! অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** বাংলাদেশের ব্র্যান্ড সাকিব!|| অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** মিরপুর টেক্কা দিচ্ছে মেলবোর্নকে ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সংস্কৃতি নিয়ে বাকযুদ্ধ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** নীল-হলুদ নাকি লাল-সবুজের ঢেউ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** চোক’ কি ক্রিকেটীয় জোক?। । অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** সাকিব-ই সেরা মানতে অসুবিধা কোথায়!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** বৃষ্টিবিলম্বিত ক্লার্কের ফেরা! না থেকেও আছেন আশরাফুল॥ ব্রিসবেন থেকে অঘোর মন্ডল
** শঙ্কার চোরা স্রোত ব্রিসবেনে॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ম্যাচের নায়করা ছিলেন বাইশ গজের বাইরে। । অঘোর মন্ডল, ক্যানবেরা থেকে
** ‘সি’ ফর ক্রিকেট নাকি সাইক্লোন!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে