ঢাকা: শেষ হলো ছয় সপ্তাহব্যাপী ক্রিকেটযজ্ঞ বিশ্বকাপ। ক্রিকেটের বিশ্বসেরা হওয়ার এ ১১তম আসরে অংশ নেওয়া ১৪টি দল ইতোমধ্যেই বসে গেছে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশে।
১৪ ফেব্রুয়ারি ক্রাইস্টচার্চের হেগলি ওভালে নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার খেলার মধ্য দিয়ে উঠেছে বিশ্বকাপের যে রঙিন পর্দা, প্রায় ছয় সপ্তাহের জমজমাট লড়াই শেষে ২৯ মার্চ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার ফাইনালের মধ্য দিয়ে নেমেছে সে পর্দা।
১৯৯৯ সালের প্রথম বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসরে বাংলাদেশের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে; ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে সে অগ্রযাত্রার গতি বেড়েছে ঈর্ষণীয় মাত্রায়। মাঝে ২০০৩ বিশ্বকাপ ছাড়া ২০০৭ বা নিজেদের মাটিতে ২০১১ বিশ্বকাপে টাইগার বাহিনী জানান দিয়েছে তাদের পরাশক্তি হয়ে ওঠার দৃঢ়প্রতিজ্ঞার কথা। ২০০৭ বা ২০১১ বিশ্বকাপের সন্তোষজনক সাফল্যের পর ২০১৫ বিশ্বকাপের অবিশ্বাস্য সাফল্য ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে যে বাংলাদেশকে ফেভারিটের তকমা দেবে না, এ কথাও কেউ জোর করে বলতে পারছেন না।
সাফল্যের গল্প সবসময়ই শ্রুতিমধুর-সুপাঠ্য। ২০১৫ বিশ্বকাপের গল্পটা তাই বারবার শুনতে-পড়তে চাইবেন টাইগার ক্রিকেটভক্তরা।
অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের আয়োজনে সমাপ্ত হওয়া এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সেই গৌরবগাঁথা সাফল্যের গল্পই পুনরাবৃত্তি করছে বাংলানিউজ।
দলীয় মহাকাব্য
বিশ্বকাপে অংশ নিতে ওশেনিয়ায় উড়াল দেওয়ার আগে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন, তারা বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে যাচ্ছেন। দুর্দান্ত খেলে সহযোদ্ধাদের নিয়ে সে প্রত্যয়ের বাস্তবায়ন দেখান টাইগার দলপতি।
গ্রুপ পর্বে দুর্বল আফগানিস্তান-স্কটল্যান্ডকে উড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে বাংলাদেশ দল। প্রথম পর্বের শেষ ম্যাচে দারুণ খেলে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের সঙ্গেও। তবে, কোয়ার্টার ফাইনালে ভারত আইসিসির সহযোগিতায় ন্যাক্কারজনকভাবে টাইগার বাহিনীকে হারিয়ে না দিলে সাফল্যের জয়রথটা যে ফাইনাল অবধি পৌঁছাতো না, সে কথাও কেউ বলতে পারছেন না।
Riayad
মেঘের আড়ালে ‘রিয়াদ’ হাসে
বিশ্বকাপ স্কোয়াডে তার নাম ঘোষণার পর অনেকে ভ্রু কুঁচকেছিলেন; ‘মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ আবার বিশ্বকাপে গিয়ে কী করবেন?’ বিশ্বকাপ শেষে এই মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকেই খুঁজেছে সেই কুঁচকানো ভ্রুওয়ালাদের কলম-ক্যামেরা।
অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ দল যে অনবদ্য মহাকাব্য লিখেছে তার কবি তালিকা শীর্ষেই যে এই মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।
বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচটিসহ ৭ খেলায় রিয়াদের রান সংগ্রহ এই রকম; ২১, ১২৮, ১০৩, ৬২, ২৮, ২৩ ও ৮৩। এসব খেলায় বল হাতে নিয়েছেন দু’টি উইকেটও। ভারতের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের বলি না হলে যে পরপর দুই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বাংলাদেশের ‘সাঙ্গাকারা’ হয়ে ওঠা রিয়াদ টানা তৃতীয় সেঞ্চুরিও করতেন না, এমনটি কোনো টাইগারপ্রেমীই বিশ্বাস করবেন না।
বিশ্বকাপের ৬ ম্যাচে রিয়াদের ব্যাটিং গড় দাঁড়ায় ৭৩। গ্রুপ পর্ব চলাকালে তিনি সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের মধ্যে শীর্ষ চারে জায়গা করে নেন। বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষে রিয়াদ দখল করে আছেন এবারের বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের মধ্যে নবম স্থান।
এর আগে, বিশ্বকাপে বাংলাদেশি কোনো ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি পর্যন্ত ছিল না। সেই হতাশা ঘুচিয়ে ১১৬ ওয়ানডে খেলা রিয়াদ টানা দু’টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। উঠে এসেছেন মার্টিন গাপটিল-কুমার সাঙ্গাকারা-এবি ডি ভিলিয়ার্সদের মতো বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানদের কাতারে।
‘মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এ রিয়াদ’ যদি ২০১৯ সালের বিশ্বকাপেও তার এমন চমক ধরে রাখেন তবে বাংলাদেশ যে সে আসরের ফাইনাল মঞ্চেও শেষ হাসি হাসতে পারবে- সে বিশ্বাসই লালন করতে চাইবেন টাইগার ক্রিকেটপ্রেমীরা।
Soumya sarker
সৌম্য, দ্য কাউন্টার অ্যাটাক স্পেশালিস্ট
তাবৎ ক্রিকেট দুনিয়ার ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যানরা সবসময়ই দায়িত্বশীল হয়ে থাকেন। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ পেয়েছে এরকম একজন দায়িত্বশীল অথচ আগ্রাসী ব্যাটসম্যান। নাম সৌম্য সরকার।
কোনো খেলায় ব্যাট করতে নেমে টাইগার দলের ওপেনিং জুটি শুরুতেই হোঁচট খেলেও ওয়ান ডাউনে নেমে উল্টো প্রতিপক্ষের দলের বোলারদের পিটিয়ে বোলিং এলোমেলো করে দেওয়ার সফল প্রয়াস দেখিয়েছেন সৌম্য। সেটা আফগানিস্তান হোক আর শ্রীলঙ্কা-ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড কিংবা ভারতই হোক।
বাহারি শটে সক্ষম সৌম্যের এই কাউন্টার অ্যাটাকে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বকাপ চলাকালেই অনেক ধারাভাষ্যকার ও সাবেক তারকা ক্রিকেটার তাকে ‘সৌম্য, দ্য কাউন্টার অ্যাটাক স্পেশালিস্ট’ তকমা দিয়েছেন।
সৌম্যের কাউন্টার অ্যাটাক দীর্ঘস্থায়ী না হলেও প্রতিপক্ষের বোলাররা এলোমেলো হয়ে যান, আর সেই সুযোগটিই কাজে লাগিয়ে মিডলঅর্ডারের ব্যাটসম্যানরা লুফে নিতে পারেন দারুণ ফল।
বিশ্বকাপে সৌম্যের কাউন্টার অ্যাটাকিং ইনিংসগুলো ছিল এরকম; ২৯, ৫১, ৪০, ২, ২৫, ২৮, ৪৫।
বিশেষ করে উল্লেখ করা যায়, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল নির্ধারণী ম্যাচে প্রথম উইকেট হারালেও সৌম্যের ৪০ রানের অ্যাটাকিং ইনিংস বাংলাদেশের রানের গতি বাড়িয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত লড়াকু ২৭৫ রান সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডকে ২৬০ রানে গুড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ।
এ কাউন্টার অ্যাটাক স্পেশালিস্ট যদি আরও পরিণত হয়ে ২০১৯ বিশ্বকাপে খেলেন, তবে তাকে নিয়েই আলাদা পরিকল্পনা করতে হবে নিঃসন্দেহে প্রতিপক্ষকে।
Taskin ahmed
নয়া গতিদানব তাসকিন আহমেদ
বোলিংয়ের প্রধান অস্ত্র পেস। আর একজন পেসারের সবচেয়ে বড় অস্ত্র গতি। এতোদিন পর্যন্ত মাশরাফি বিন মর্তুজাই বাংলাদেশের গতিদানব বলে পরিচিত থাকলেও এবারের বিশ্বকাপ টাইগার বাহিনীকে দিয়েছে নতুন এক গতিদানব। সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া ২০ বছর বয়সী এই গতিদানবের নাম তাসকিন আহমেদ।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের গতির ঝড়ে নাকানি-চুবানি দেওয়া তাসকিনের বোলিংয়ে মুগ্ধ হয়ে ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি স্যার ইয়ান বোথাম পর্যন্ত বলেছেন, এই ছেলে একদিন ব্যাটসম্যানদের শাসন করবে।
পুরো বিশ্বকাপে গড়ে ১৪০ কিলোমিটার বেগে বল করা তাসকিন সর্বোচ্চ ১৪৫ কিলোমিটার গড়েও বল ছুঁড়েছেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের দিকে। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ উইকেট নিয়েছেন এই তাসকিনই।
আগামী বিশ্বকাপে তাসকিনের বয়স দাঁড়াবে ২৪ বছর। চারবছর নিজেকে ঝালিয়ে তাসকিন ওই বিশ্বকাপে নিঃসন্দেহে বলের কাঠামোয় তীর ছুঁড়বেন, আর সে শঙ্কায় এখন থেকেই দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ উঠতে পারে প্রতিপক্ষের কপালে।
উজ্জ্বল মাশরাফি-রুবেল-মুশফিক-সাব্বির
রিয়াদ, সৌম্য, তাসকিনদের আলোয় এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশের নাম যেমন অনেক বেশি উজ্জ্বল দেখা গেছে, তেমনি এই ঔজ্জ্বল্যকে আরও বেশি ঈর্ষণীয় করার প্রয়াস দেখিয়েছেন অধিনায়ক মাশরাফি, স্পিডস্টার রুবেল হোসেন, তারকা ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম ও অলরাউন্ডার সাব্বির রহমান।
২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যে সাফল্যের পর্বতে আরোহন শুরু করেছে, ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে নিশ্চয় সে পর্বতের এভারেস্টসীমায় পৌঁছে যাবে। সেই প্রত্যাশা-বিশ্বাসের মধুর অপেক্ষায় চার বছর কাটবে ক্রিকেটপ্রেমীদের।
বাংলাদেশ সময়: ০৫২৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৫