ঢাকা: সমাজে পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছেন প্রতিবন্ধীরা। আর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা সেই দিক দিয়ে আরো বেশি পিছিয়ে।
সমাজের এক শ্রেণির লোক তাদের ‘কানা’ বলে তাচ্ছিল্য করেন। সেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরাই এবার দেশের হয়ে গৌরব বয়ে আনলেন। দেশের মানুষের মুখ উজ্জ্বল করলো ক্রীড়া নৈপুণ্যের মাধ্যমে।
সাকিব, মাশরাফিদের মতো ওরাও বিশ্বক্রিকেটে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরলেন সম্মানের সঙ্গে।
জাতীয় ক্রিকেট দলের একজন খেলোয়াড়ের পেছনে যে ব্যয় ও শ্রম দেওয়া হয়, তার চার ভাগের একভাগও পান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেটাররা। তারপরেও তাদের অদম্য মেধা আর শ্রমের কারণে কলকাতার ত্রিবঙ্গীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে ‘বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট দল’।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল যে বছর টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা পেলো, সেই ২০০০ সালেই গঠিত হয়- ‘বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট দল’। শুরুতে কয়েকজন খেলোয়াড় নিয়ে গঠিত হয় এই জাতীয় ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলটি।
এরপর ১২টি দল গঠন করা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, যশোর, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সাতক্ষীরা, সিলেট, কক্সবাজারসহ ১২টি অঞ্চলে রয়েছে ‘ব্লাইন্ড ক্রিকেট টিম’। এদের মধ্য থেকে বাছাই করে ‘জাতীয় ব্লাইন্ড ক্রিকেট দল’ গঠন করা হয়- এ সব কথা বলছিলেন ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলের কোচ মো. ছানোয়ার আহমেদ।
জাতীয় সংসদের আইপিডি হলে ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলের সংবর্ধনা শেষে এসব কথা বলেন তিনি।
কলকাতায় সদ্য অনুষ্ঠিত ত্রিবঙ্গীয় টি-২০ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে যুগ্মচ্যাম্পিয়ন হয় (বিবিসিসি)। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেটারদের সংবর্ধনা দেওয়া হয় জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে।
তিন ক্যাটাগরিতে ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় বাছাই করা হয়। এর মধ্যে বি-১ ক্যাটাগরির খেলোয়াড়রা কিছুই দেখতে পান না। বি-২ ক্যাটাগরির খেলোয়াড়েরা ৫ মিটার দূরত্বের বস্তু দেখতে পান এবং বি-৩ ক্যাটাগরির খেলোয়াড়েরা ১৫ মিটার দূরত্বের কোনো বস্তু দেখতে পান না।
ফিল্ডিং করার সময় বি-১ ক্যাটাগরির খেলোয়াড়েরা থাকেন কাছাকাছি জায়গায়। বাকিরা সীমানার কাছে ফিল্ডিং করে থাকেন। বি-১ ক্যাটাগরির খেলোয়াড়েরা বল ধরে ৫ মিটার পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পারেন। এরপর অন্যরা এসে বলে নিয়ে সহযোগিতা করেন।
মূলধারা ক্রিকেটের সঙ্গে এদের পার্থক্য শুধুমাত্র বল করার ক্ষেত্রে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা বল করেন গ্রাউন্ডে। অর্থাৎ হাত ঘুরিয়ে মাটির ওপর বল গড়িয়ে দেন। আর বলের শব্দেই খেলোয়াড়েরা চার, ছয় হাঁকান। চোখে না দেখলেও বল করেন ব্যাটের শব্দে। এভাবে শব্দ শুনেই ওরা দৌড়ান।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জাতীয় দল ২০১২ সালে ভারতের ব্যাঙ্গালুরে অনুষ্ঠিত টি-২০ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে ৭ম স্থান অধিকার করে। এরপর ২০১৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত একদিনের ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে ৫ম স্থান অধিকার করেন।
বাংলাদেশ মূল ধারার জাতীয় ক্রিকেট দলগুলো যেসব দেশের সঙ্গে লড়াই করেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা সে সব দেশের সঙ্গেই লড়াই করেন।
ত্রিবঙ্গীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া খেলোয়াড়দের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়।
সহকারী অধিনায়ক বাদল কুমার দাস তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বাংলানিউজকে বলেন, খুবই ভালো লাগে যখন বাইরের কোনো দেশকে হারাতে পারি। আমরা তো ম্যাচ প্র্যাকটিস করার সুযোগ পাই না। যখন আন্তর্জাতিক কোনো টুর্নামেন্টের খবর আসে, তখন মানিকগঞ্জের মন্টপপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে গিয়ে ৩ থেকে ৪ মাস প্র্যাকটিস করি। এর বাইরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝে-মধ্যে প্র্যাকটিস করি।
বাদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ কল্যাণ বিভাগের মাস্টার্সের প্রথমবর্ষের ছাত্র।
বি-১ ক্যাটাগরির খেলোয়াড় মো. খোরশেদ আলম। জন্ম থেকেই চোখে দেখেন না। তারপরেও থেমে নেই তার জীবন চলার পথ। বাড়ি কুমিল্লায়। পড়েন ঢাকা কলেজে, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। স্থান পেয়েছেন ব্লাইন্ড জাতীয় ক্রিকেট দলে।
মো. মনিরুল পড়েন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনিও ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলের সদস্য।
ত্রিবঙ্গীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা সুযোগ পেলে একদিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবো। আশা করি, জাতীয় ক্রিকেট দলের আগেই আমরা সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো।
ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলের অন্য সদস্যরা হলেন- শাহাদত হোসেন, মো. রিপন, জসিম, তানজিরুল, হাফিজুর রহমান বুলেট (অধিনায়ক), আব্দুল মালেক, আবু নাইম মাসুম, আবিদ হোসেন, মামুনুল ইসলাম ও ইব্রাহিম।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৫
এসএম/এবি
** ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলকে সংসদের সংবর্ধনা