চট্টগ্রাম: ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত, ছোড ছোড ঢেউ তুলি/লুসাই ফা-রত্তুন লামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী’ কিংবা ‘ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা’- এমন সব বিখ্যাত গানে যে স্রোতস্বিনীর কথা উঠে এসেছে, দখল আর দূষণে সেই কর্ণফুলী নদী দিনে দিনে তার রূপ হারিয়েছে।
দুই পাড়ে গড়ে ওঠা কল-কারখানা আর নগরের ময়লা-আবর্জনা চট্টগ্রামের লাইফলাইন কর্ণফুলীর দূষণের মাত্রা বাড়িয়েই চলেছে।
কর্ণফুলীর চাক্তাই খাল সংলগ্ন অংশে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পাড়ে নৌকায় বসে জাল দিয়ে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করছে শিশু ইয়াসিন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা নদীর পানি ও পলিতে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ কণা খুঁজে পেয়েছেন। এ গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বেশি বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে মিশছে। এর মধ্যে আবার শিল্পকারখানা, পর্যটন, আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যও রয়েছে। এসব বর্জ্যের সঙ্গে নদীর পানি ও পলিতে গিয়ে মিশছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। এ কণা দূষণের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ও বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে বহন করতে পারে। যখন মাছ, কাঁকড়া, শামুক এই কণাগুলো খেয়ে ফেলে তা খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত মানুষের দেহেও পৌঁছে যায়। এতে পরিবেশগত ঝুঁকির পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে।
শুধু কি দূষণ, দীর্ঘদিন ধরেই চলছে নদী দখল। এতে ছোট হয়ে আসছে কর্ণফুলী। নদীর তীর দখল করে গড়ে উঠেছে ট্রাক স্ট্যান্ড। অন্যপাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে বালি। চাক্তাই খালের অংশে আবার অবৈধ স্থাপনাও গড়ে উঠেছে নদী দখল করে।
এ নদী ঘিরে যাদের জীবন-জীবিকা, সেই সাম্পান মাঝি ও জেলেদের সাথেও কথা হয়। বোটচালক সানাউল্লাহ। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে দেখেছেন কিভাবে একটু একটু করে কর্ণফুলী নদী দখল হয়ে গেছে। আগে কেমন ছিল কর্ণফুলী, জিজ্ঞেস করতেই হাত দিয়ে দূরে ইশারা করে বললেন নদীর আগের অবস্থা।
তিনি জানান, আগে এ নদী অনেক প্রশস্ত ছিল। দূষণও ছিল না। নদী থেকে খালের মধ্য দিয়ে অনেক ভেতরে বোট নিয়ে যাওয়া যেত। এখন সেখানে বাজার ও বিভিন্ন স্থাপনা।
জেলেরা জানান, একসময় রাম ফাঁইস্যা, মধু ফাঁইস্যা, রিস্যা, পোপা, বাটা, বাচা, চেউয়া, টেংরা, চিড়িং, আইড়, বাইলাসহ হরেক প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। গত ১০-১২ বছরে ব্যাপক হারে কমে গেছে এসব মাছ। ডিঙি নৌকা করে নদীতে মাছ ধরা হতো। কলকারখানার বর্জ্যের কারণে অনেক মাছ এখন পাওয়া যায় না। নদীতে ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে বালু তোলার ড্রেজার। তাই মাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্ণফুলী নদী বাঁচাতে যত দ্রুত সম্ভব নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। আর তা যদি করা না হয় কর্ণফুলী নদীও একসময় বুড়িগঙ্গার মতো রূপ নেবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও নদী গবেষক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বাংলানিউজকে বলেন, কর্ণফুলী শুধু একটি নদী নয় এটি দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। চট্টগ্রাম শহর-বন্দর গড়ে উঠেছে এ নদীকে কেন্দ্র করে। এর তীরে পণ্য ও কাঁচামাল পরিবহন সহজ হওয়ায় অনেক কলকারখানা গড়ে উঠেছে। কারাখানার বর্জ্য তো বটেই সিটি করপোরেশনের কোনো পয়োঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় এ বর্জ্যও নদীতে সরাসরি পড়ছে। যদি নদীতে জোয়ার ভাটা না থাকতো তাহলে এ নদীর কোনো জীববৈচিত্র্য অবশিষ্ট থাকতো না।
তিনি আরও বলেন, ১৯৮৬ সালের একটি তথ্য বলছে, এ নদীতে ৫৯ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ ও ৬৫ প্রজাতির ব্রাকিশ ওয়াটার (স্বাদু-নোনা মিশ্রিত পানি) মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু কর্ণফুলী দখল ও দূষণের ব্যাপকতা এত বেশি যে, এখন শুধুমাত্র ৪-৫টি প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। ১৯৬৪ সালে কাপ্তাই বাঁধের ফলে স্রোত বাধাগ্রস্ত করার মাধ্যমে কর্ণফুলীকে মেরে ফেলা হয়েছে। কর্ণফুলীর তীরের জেলেদের জীবন-জীবিকা আগে এ নদীর ওপর নির্ভর করতো। কিন্তু এখন জেলেরা সারাদিন জাল ফেলে মাছ পাচ্ছে না। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে কর্ণফুলীকে বাঁচাতে হবে।
এসএস/টিসি