ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

আহত-পঙ্গু শ্রমিকদের যেন কোনো অজুহাতে ছাঁটাই করা না হয়

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩১ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০২৪
আহত-পঙ্গু শ্রমিকদের যেন কোনো অজুহাতে ছাঁটাই করা না হয় ড. এম এম আকাশ ও রাজেকুজ্জামান রতন

ঢাকা: সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় সরকারি হিসাব অনুসারে প্রায় দেড়শ প্রাণহানি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে শত শত কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদের।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়টি প্রলম্বিত হয়েছে সরকারের অবিমৃষ্যতার কারণে। এই আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দাবি করে শ্রমিক নেতারা বলছেন, আহত ও পঙ্গু হওয়ার কারণে কোনো শ্রমিক যেন তার কর্মস্থলে ছাঁটাইয়ের শিকার না হন।

সহিংসতা ও এতে প্রাণহানি-ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্লেষক ড. এম এম আকাশ এবং সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতনের।

ড. এম এম আকাশ বলেন, কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়টি প্রলম্বিত হয়েছে সরকারের অবিমৃষ্যতার কারণে।  সরকার এই আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও গভীরতা অনুধাবন না করে আদালতের ওপর ছেড়ে দিয়েছিল এবং তা দীর্ঘসূত্র হয়। ‘বাংলা ব্লকেড’ ও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’র মতো কর্মসূচিতে আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তখন সরকার মনে করেছে, তার অঙ্গ সংগঠনগুলো দিয়েই দমন করা যাবে। কোথাও কোথাও সরকারের সমর্থকদের সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সংঘাতের সূচনা হয়। এই ফাঁকে সরকার উৎখাতে আগ্রহী রাজনৈতিক শক্তি এখানে ঢুকে পড়ে। তারা এটাকে সরকার উৎখাতের আন্দোলনে পরিণত করতে চায়।  

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সহিংসতার সময় কিছু কিছু সরকারি স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়া হয় ও ধ্বংস করা হয়। অবশ্য এটা ঠিক কারা করেছে, এটা তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না। এই কাজগুলো করার জন্য যে অর্থ প্রয়োজন হয়েছে সেই অর্থ কোথা থেকে এসেছে সেটাও এখনো উদ্ঘাটিত হয়নি। সুতরাং এই তদন্ত চলতে থাকুক। কিন্তু যেটা সবচেয়ে দুঃখজনক তা হচ্ছে সরকার এই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়েছে। লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস দিয়ে এই আন্দোলনকে দমন করতে না পেরে সরকার ছররা গুলি ব্যবহার করে এবং হেলিকপ্টার ব্যবহার করে এমন সব কাজ করেছে। যাতে অনেক নিরীহ লোক ও আন্দোলনকারী মারা গেছে।

এম এম আকাশ বলেন, নিহতের সংখ্যা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা আছে। ধারণা করা হচ্ছে এর প্রকৃত সংখ্যা ২০০ এর বেশি হবে। ইতোমধ্যে আমরা ১৫০ জনের একটি হিসাব পেয়েছি। ২৯ জুলাই একটি জাতীয় পত্রিকায় বিষয়টি এসেছে। সেখানে ৮৬ জনের হিসাব পাওয়া যায়, তারা একান্তই নিরাপদ শ্রমজীবী জনগণ।

পত্রিকাটি যে হিসাব দিয়েছে তা অনুসারে, নিহত ১৫০ জনের মধ্যে শিক্ষার্থী ৪৫ জন। শ্রমজীবী মানুষ ৮৬ জন। এর মধ্যে সরাসরি শ্রমজীবী মানুষ ৭০ জন। শ্রমজীবীদের মধ্যে সরাসরি গার্মেন্টস শ্রমিক পাঁচজন। দোকান, হোটেল ও বিক্রয়কেন্দ্রের কর্মী ২৫ জন; ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকার ১৬ জন; দিনমজুর ১১ জন; গাড়িচালক, রিকশাচালক ও তাদের সহকারী ১৩ জন। আর পুলিশ, সাংবাদিক ও চাকরীজীবী মারা গেছেন ১৬ জন। এর বাইরে আরও ১৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন।  

এত শ্রমজীবীর মৃত্যুর বিষয়ে এম এম আকাশ বলেন, হয়তো তারা আন্দোলনে ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিল বা তারা ঘরের বাইরে কোনো কাজে বের হয়েছিল এবং পুলিশের গুলিতে বা কোনো বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে। সুতরাং এই দায় সরকার এড়াতে পারে না। এই হত্যাকাণ্ডের ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায় এড়ানো যাবে না। হত্যাকাণ্ড কীভাবে ঘটলো, কেন ঘটলো, কারা গুলির নির্দেশ দিল, কারা গুলি করলো—এর প্রত্যেকটি তদন্ত করে দোষীকে শাস্তি দিতে হবে।

এই অর্থনীতিবিদের মতে, যেহেতু পুঞ্জীভূত এক ধরনের ক্ষোভ সরকারের বিরুদ্ধে জমা হয়েছে, সেজন্য ভবিষ্যতেও এ ধরনের আন্দোলন হবে বা হতে পারে। এর চূড়ান্ত সমাধান হবে একটি পরিচ্ছন্ন গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে।

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতনের অভিমত, যে কোনো আন্দোলনে দেশের শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণের বিষয় উপেক্ষা করার মতো নয়। কারণ দেশের বর্তমানের সঙ্গে যেমন শ্রম জড়িয়ে থাকে, ভবিষ্যতের জন্য স্বপ্ন ও আশা জড়িয়ে থাকে।

তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, এমনকি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনেও আমাদের শ্রমিকদের জীবন দিতে দেখেছি। এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রূপ নিল, বৈষম্যের বেদনা শ্রমিককের বুকে কী পরিমাণে বাজে, সেটা জীবন দিয়েই উপলব্ধি করালেন তারা।

রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, এই আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষ প্রত্যক্ষভাবে অংশ না নিলেও একাত্ম হয়ে গিয়েছিল এবং অনেকে আবার কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে বা ফেরার পথে নানাভাবে যুক্ত হয়েছে। ফলে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে আহত ও নিহত শ্রমিকদের যে তথ্য দেখেছি, সেখানে এক হাজার ৭৩ জন চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৩৫২ জন ভর্তি হয়েছিলেন এবং আইসিইউতে আছেন ৩০ জন। এদের মধ্যে শ্রমজীবী মানুষই ৯০ শতাংশ। তারা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আসলে যেখানে মানুষের বেদনা, যেখানে মানুষের সংগ্রাম, যেখানে আন্দোলন, সেখানে নানাভাবে আমাদের শ্রমজীবী মানুষ। অবশ্য এই জীবন দানের পর তারা স্বীকৃতিও পান না। তাদের স্বপ্নও পূরণ হয় না। ।

এই শ্রমিক নেতা বলেন, আন্দোলনে পুলিশের হামলা, গুলিবর্ষণে, নির্যাতনে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যারা আহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, যেসব শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে যেতে পারছেন না, তাদের কোনো অজুহাতে যেন ছাঁটাই না করা হয়। এটা আমরা দেখতে চাই। আরেকটি বিষয়, আন্দোলনের সময় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। আমরা চাই কোনোভাবেই যেন এই সময় তাদের কর্মচ্যুতি বা তাদের কর্ম থেকে যেন কোনোভাবেই বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র না করা হয়।

শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপনের যে কষ্ট, চাকরি ক্ষেত্রে যে অনিশ্চয়তা, তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করানোর ক্ষেত্রে যে অসহায়ত্ব, সমস্ত কিছুই নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে রাজেকুজ্জামান রতন শ্রমজীবী মানুষের সংকটের দিকে নজর দেওয়ার তাগিদ দেন।

তিনি বলেন, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, কর্মপরিবেশ ও তাদের কর্মজীবন শেষে নিরাপত্তার যে বিষয়টি তা নিশ্চিত করতে হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৭ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০২৪
জেডএ/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।