ঢাকা, শনিবার, ১৯ মাঘ ১৪৩১, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১ শাবান ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ট্রাম্পের সহায়তা বন্ধের আদেশ দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশে

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫
ট্রাম্পের সহায়তা বন্ধের আদেশ দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশে সংগৃহীত ছবি

ঢাকা: যুক্তরাষ্ট্র বিদেশে সব ধরনের সহায়তা কার্যক্রম স্থগিত করেছে এবং নতুন সাহায্য অনুমোদন বন্ধ রেখেছে। ফলে বিশ্বের অনেক দেশ বিপাকে পড়বে।

এরমধ্যে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে যদি এই স্থগিতাদেশ থাকে তাহলে বাজেট সাপোর্টসহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলেন, স্বল্পমেয়াদে হলে তেমন কোনো প্রভাব না পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বাজেট সাপোর্টসহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় সমস্যা হবে। এজন্য আমাদের এখান থেকেই ডিপ্লোম্যাটিক উদ্যোগের নিতে হবে৷ তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে৷ তাদেরকে এটা বোঝাতে হবে যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সহযোগী দেশ। ফলে এখন থেকে লবিং করতে হবে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ. বি. এম. মো. আজিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিদেশে সব ধরনের সহায়তা কার্যক্রম স্থগিত করেছে সেটা স্বল্প মেয়াদে হলে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ, দেশটির আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড’র মাধ্যমে বাংলাদেশে যে সাহায্য আসে সেটার পরিমাণ খুব বেশি না। তবে বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) জাতিসংঘের যে সব উন্নয়ন সংস্থা আছে তাদের যদি যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান কমে যায় তাহলে বাংলাদেশের বাজেট সাপোর্টসহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রকল্পগুলোয় সমস্যা হবে।

তিনি বলেন, এর বাইরে বেশি কিছু এ মুহূর্তে হওয়ার কথা নয়। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে হলে প্রভাব পড়বে কিনা সেটা নির্ভর করবে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অর্থায়ন কতদিন বন্ধ থাকে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে সেটা বিশ্বের দুটি দেশ বাদে সকল দেশের জন্য প্রযোজ্য৷ তবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে সহযোগিতা তার ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তারা এটা তিন মাস পরে রিভিউ করবে। তখন তারা কি সিদ্ধান্ত নেবে সেখানে বাংলাদেশের কি ভূমিকা থাকবে। মোট কথা এটা একটা চাপ সৃষ্টিরও কৌশল হিসেবে দেখা যেতে পারে।

তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ও অ-প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে থাকে। তারা বিভিন্ন সংস্থাকে সহযোগিতা করে। সে সব সংস্থা আবার বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন মুলক কার্যক্রম করে। এখন এসব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। আবার অনেকেই তিন মাস পরে যখন কার্যক্রম শুরু করবে তখন পিকআপ করার মতো অবস্থায় নাও থাকতে পারে। এজন্য বিভিন্ন দেশ চাইবে যাতে রিভিউটা ইতিবাচক হয়। সুতরাং আমাদের এখানে ডিপ্লোম্যাটিক উদ্যোগের বিষয় আছে।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের বিভিন্নভাবে তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে৷ তাদেরকে এটা বোঝাতে হবে যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সহযোগী দেশ। ফলে এখন থেকে লবিং করতে হবে। সেটা ঢাকায় করতে হবে ওয়াশিংটনেও করতে হবে। যাতে তিন মাস পরে তারা যে সিদ্ধান্তটা নেবে সেখানে যেন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সহযোগিতা কন্টিনিউ করে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজার) সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিদেশে সব ধরনের সহায়তা কার্যক্রম স্থগিতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিনিয়োগের সরাসরি তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে সে রকম কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে বিনিয়োগ বাড়াতে পলিসি সহজীকরণ করতে হবে। আমরা চলতি অর্থবছরের মাঝ পথে আছি। আর হয়তো ৪ মাস আছে। তাই এই অর্থবছরে প্রভাব পড়বে। যদি যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা কার্যক্রম স্থগিতের সময় তিন মাসের বেশি দীর্ঘায়িত না করে। তবে তিন মাসের বেশি বাড়ায় তাহলে আমাদের পরবর্তী অর্থবছরের বাজেটে ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে প্রভাব ফেলবে। এজন্য সরকারকে এখন থেকেই নেগোসিয়েশন করে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী পলিসি নির্ধারণ করতে হবে।

এদিকে গত ২৫ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র বিদেশে সব ধরনের সহায়তা কার্যক্রম স্থগিত করেছে এবং নতুন সাহায্য অনুমোদন বন্ধ রেখেছে। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশেও সহযোগিতা কার্যক্রম স্থগিত করেছে দেশটির আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ও বিদেশি দূতাবাসগুলোয় এই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।

ইউএসএইডের চিঠিতে বলা হয়, ইউএসএআইডি, বাংলাদেশ বাস্তবায়নকারী সব অংশীদারদের চুক্তি, কার্যাদেশ, অনুদান, সমবায় চুক্তি বা অন্যান্য অধিগ্রহণ বা সহায়তা স্মারকের অধীনে সম্পাদিত যেকোনো কাজ অবিলম্বে বন্ধ অথবা স্থগিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের প্রাপ্ত বরাদ্দ থেকে ব্যয় কমানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এছাড়া লিখিত কোনো নির্দেশ না আসা পর্যন্ত কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে রেফারেন্স হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া এ সংক্রান্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নে দ্রুত একটি গাইডলাইন পাঠানোর কথাও বলা হয়।

প্রসঙ্গত, গত ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নিয়েই ৯০ দিনের জন্য বৈদেশিক সহায়তা স্থগিত করে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। এরপরই সহযোগিতা বন্ধের বিষয় প্রকাশ্যে আসে। দেশটির ফাঁস হওয়া অভ্যন্তরীণ নথিতে এ তথ্য জানা গেছে। নথি অনুযায়ী, আগামী ৯০ দিনের জন্য সব মার্কিন বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচি সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যেসব বৈদেশিক সহযোগিতা স্থগিত করা হয়েছে, সেগুলো বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা খতিয়েও দেখা হচ্ছে।

জানা গেছে, উন্নয়ন সহায়তা বন্ধ হলে এইডস ত্রাণবিষয়ক প্রেসিডেন্টের জরুরি পরিকল্পনা বা পিইপিএফএআরের তহবিল বন্ধ হয়ে যাবে। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোয়, বিশেষ করে আফ্রিকায় এইডসের চিকিৎসায় ওষুধ কেনা হয়। ২০০৩ সালের জর্জ ডব্লিউ বুশ পিইপিএফএআর চালু করেছিলেন। ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের জীবন বাঁচাতে এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ গণতন্ত্র ও শাসন, মৌলিক শিক্ষা এবং পরিবেশগত কার্যক্রমের পাশাপাশি বিশ্বের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য কর্মসূচি নিয়ে বাংলাদেশে ইউএসএআইডি কর্মসূচি এশিয়ার বৃহত্তম। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় ইউএসএআইডি বাংলাদেশে বড় ধরনের মানবিক সহায়তা তদারকি করে। তবে এই আদেশের প্রভাব জরুরি খাদ্য সহায়তার ওপর নাও পড়তে পারে বলে জানা গেছে।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র ২০২৩ সালে ৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি সহায়তা কেবল যে মানবিক সহায়তা তা নয়, বরং এর উদ্দেশ্য বহুবিধ। মানবিক সহায়তার পরিমাণ খুবই কম। বরং সেই তুলনায় সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে সামরিক সহায়তা বন্ধ হলে বিশ্বের কিছু মানুষের জীবনে শান্তি আসবে, সে কথা বলাই যায়। যদিও ইসরায়েল ও মিসরকে দেওয়া অস্ত্র সহায়তা অব্যাহত থাকবে। ৯০ দিন পর তারা এই কর্মসূচি পর্যালোচনা করবে। অর্থাৎ সহায়তা হয়তো চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে না।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫
জিসিজি/এমজে

 
 

 

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।