কুষ্টিয়া: ছয় বছর ধরে দেশের বৃহৎ গঙ্গা-কপোতাক্ষ বা জিকে সেচপ্রকল্পের পাম্প হাউজ অকেজো থাকায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে ভূ-উপরিস্থ জলাধার। এতে কৃষি, গৃহস্থালীসহ পানির ওপর নির্ভরশীল ক্ষেত্রগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
তিন জেলার কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান মতে, এখানে প্রায় দুই লাখ ৩২ হাজার হেক্টর সেচযোগ্য অতি উর্বর তিন ফসলি জমিতে সেচ সরবরাহে চালু রয়েছে ৫৮৩টি গভীর নলকূপ, ৩২৭টি এলএলপি এবং এক লাখ ১৩ হাজার নয়শ ৫১টি অগভীর নলকূপ।
এই পরিসংখ্যানের ভয়াবহ চিত্রই বলে দেয় যে সরাসরি গৃহস্থালী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূগর্ভস্থ পানির যোগানস্তরের উপর কৃষি কাজের সেচ সরবরাহে ব্যবহৃত প্রায় সোয়া লাখ অগভীর নলকুপে পানির যোগান দিতে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর।
প্রতিনিয়ত পানীয়জলের নির্ধারিত মজুতকে ক্ষয়ে দেওয়ার মাত্রা ঊর্ধ্বগামী করে তুলেছে। এমন পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে সংকট নিরসরনর দাবি ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী ও কৃষকদের।
এক্ষেত্রে পানি বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পরিকল্পিত পানি ব্যবস্থাপনা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। তবে, তাৎক্ষণিকভাবে বিকল্প উপায়ে বৃহৎ ক্ষেত্রে নিরাপদ সেচ ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণে ইতিবাচক সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার কথা জানালেন বিএডিসির প্রকল্প কর্মকর্তা।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কবরবাড়িয়া গ্রামের রাবিয়া খাতুন বলেন, ‘পানির সমেস্যা কি একটু আইট্টু হয়চে নাকি? পানির অভাবে সেচ দিতি না পাইরি ধানের মাঠ ফাইটি ছেড়াবেড়া হয়ে গেচে। একন আমরা ছাওয়াল পাল লিয়ে কি খাবো সেই চিন্তাই করতিচি, বাড়িত টিউকলের পানিও ওটতেচে না; গরু বাচুর, ছাগল বকরি, হাঁস মুরগি লিয়ে একন কোন যাই কি করি, কোন দিশা হচ্চেনা’। কবে ইর সুমাধান হবি আর কবেই বাঁচতি পারবো, সেই বেবেস্তা সরকার কইরি দিক’।
মেহেরপুর সদর উপজেলার ফতেপুর গ্রামের কৃষক মিরাউল হক বলেন, ‘আমারে যত কষ্ট এই শুষ্ক মৌসুমে, ধরেন সারা বছরই আমারে এই মাঠে আবাদ করি বাঁচতি হয় শ্যালো পাম্পের (অগভীর নলকুপ) পনির উপর। প্রতি বছরই নতুন নতুন কইরি পানির লিয়ার (স্তর) নিচে নাইমি যাচ্ছে। দেকা যাইচ্ছে, ২ থেইকি ৫ ঘণ্টা পর্যন্ত মটর চালিউ এক বিগি ভুঁই ভিজাইত পাচ্চিনি’। এতে যে খচ্চা হইচ্চে, তাতে আবাদ কইরি খরচই উইটপে না। সরকার যদি মাটের মধ্যি মধ্যি মোটা পাইপের ডিপটি (গভীর নলকুপ) বসা দিতি তাহলি হয়ত আমারে জানডা এট্টু বাঁইচতি’।
পরিবেশবিদ গৌতম কুমার রায় বলেন, আমাদের জীবনের মূল চলকশক্তি হলো পানি। পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশিরাই ভাগ্যবান যে এতো সহজে সুপেয় পানির চাহিদা পুরন করছি যা পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও এমন অ্যাকসেস নাই। অথচ সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে পানির মর্ম না বুঝতে পারায় আমরা দিন দিন মরুময়তার দিতে ধাবিত হচ্ছি।
তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমের যে পানি আমরা পাই সেগুলিকে যদি ধরে রাখার জলাধার সৃষ্টি করতে পারতাম তাহলে আজ এমন হাপিত্যেস করতে হতো না। আমাদের সমুদ্র উপকূলের মানুষ জীবন ধারনের জন্য বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রেখে সারা বছর সুপেয় পানির সংস্থান করে থাকে। এমন উদাহরণ তো আমাদের দেশেই আছে; মানুষ তার প্রয়োজনে সব পারে।
গৌতম কুমার রায়ের আশংকা, আজকে আমাদের ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তরের উপর যে মাত্রাতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে গৃহস্থালী ও জীববৈচিত্র্যকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে সেই সংকট উত্তরণে এখনই কার্যকরী উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে অবশ্যম্ভাবী মহামারি থেকে আমরা কেউই মুক্ত হবো না।
কুষ্টিয়া জনস্বাস্থ্য বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ইব্রাহিম মো: তৈমুর বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ঊর্ধ্বগামী তাপদাহে জীববৈচিত্র্যসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহতা থেকে উত্তরণে প্রাধিকার বিবেচনায় সমন্বিত পরিকল্পা গ্রহণ এবং পানিসংশ্লিষ্ট বিভাগগুলির পক্ষ থেকে বাস্তবানুগ উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প পথ নেই। এক্ষেত্রে ভূ-উপরিস্থ জলাধার সংরক্ষণ এবং অত্যাবশ্যক প্রয়োজন বিবেচনায় গভীর নলকূল স্থাপন করে ভূগর্ভস্থ অগভীর স্তরের সুপেয় পানির মজুত সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। না হলে প্রতি বছরই পানির এই স্তর ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে বর্তমানে বছরের প্রায় ছয় মাস পানির লেয়ার সংকটে থাকে অগভীর স্তরের পানি সংগ্রহের যন্ত্রগুলি।
তিনি বলেন, আগামীতে হয়তো এই সংকটকালের পরিধি ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী হতেই থাকবে; কারণ বিজ্ঞানীরা বলছেন ২০৭০ সাল নাগাদ অতিরিক্ত আরও তিন ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলার ভূগর্ভস্থ পানির মজুত সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
কৃষি জমিতে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী খরচে সেচ সরবরাহে অতি নগন্য বা অপ্রতুল হলেও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশ বিএডিসি গভীর নলকূপ ও এলএলপি পাম্পের মাধ্যমে উপরিস্থ জলাধারের পানি থেকে সেচ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে ফসল উৎপাদন খরচ হ্রাসের যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে তার বিবরণ তুলে ধরার পাশাপশি এই ধরনের সেচ ব্যবস্থা আরও শতগুণ বেশি সম্প্রসারণের দাবি চাষিদের।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দিগড়ী গ্রামের সুভিধাভোগী চাষি দেলুয়ার হোসেন বলেন, আমাদের মাঠ অতি উর্বব দো’আশ মাটি হলেও অনেক উঁচু হওয়ায় সেচ সংকটে দীর্ঘদিন ধরেই দো-ফসলি ছিল। গত দুই বছর আগে বিএডিসির ‘মুজিবনগর সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্প’ গভীর নলকূল স্থাপন করে এর আশপাশে প্রায় তিনশ’ বিঘা জমি এখন তিন ফসলি হয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ চালিত সরকারি এই পাম্পে একদিকে সীমিত সেচ খরচ, অন্যদিনে পূর্বে এই তিনশ’ বিঘা জমিতে ছিল ৭২টি অগভীর শ্যালো। এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে।
মেহেরপুরের রশিকপুর গ্রামের চাষি তাহের উদ্দিন বলেন, দুই বছর আগে আমাদের ভৈরব নদীর পানি দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করে দিয়েছে বিএডিসি। খুব অল্প সময় এবং সামান্য খরচেই এলএলপি পাম্পের পানিতে আমরা ভুঁই ভিজাতি পারছি।
বিএডিসি (সেচ বিভাগ) কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক আলি আশরাফ বলেন, আধুনিক সেচ প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এজন্য উপরিস্থ জলাধারের পানি সেচ কাজে সম্প্রসারণ করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে স্বল্প খরচে অতিরিক্ত আরও ৬৫ হাজার ছয়শ’ ২০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মুজিবনগর সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব হবে।
যদিও প্রয়োজনের তুলনায় এই প্রকল্পের পরিধি দশ শতাংশও নয় বলে দাবি করেন আলি আশরাফ। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলা করে ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রকল্পের আওতা বা পরিধি সম্প্রসারণে ইতিমধ্যে উন্নয়ন প্রস্তাবনা প্রস্তুত করেছেন বলেও জানালেন তিনি।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ঊর্ধ্বগামী তাপদাহে কৃষি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব বিবেচনায় জরুরি ভিত্তিতে পরিকল্পিত পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট মহল।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০২৫
এসএইচ