ঢাকা, শুক্রবার, ১ কার্তিক ১৪৩২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৭

অর্থনীতি-ব্যবসা

দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে ভারসাম্যপূর্ণ সুদহার জরুরি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৫৪, অক্টোবর ১৬, ২০২৫
দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে ভারসাম্যপূর্ণ সুদহার জরুরি

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাংক সুদহার জরুরি। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পাল্লা দিয়ে বাড়াচ্ছে আমানত ও ঋণের সুদ হার।

বর্তমানে বাংলাদেশে সুদের হার ১৪ শতাংশের ওপরে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ১০ থেকে ১১ শতাংশ মুনাফা করে। এ অবস্থায় এই উচ্চ সুদ কোনোভাবেই ব্যবসাবান্ধব নয়। উচ্চ হারে ঋণ নিয়ে বিশ্ববাজারে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমান মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ হলো উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাজারে সরবরাহজনিত কাঠামোগত সমস্যা। এই পরিস্থিতিতে, যখন মূল্যস্ফীতি সরবরাহজনিত কারণে ঘটে, তখন শুধু সুদের হার বাড়ানোর নীতি বিনিয়োগকে দুর্বল করে দিতে পারে এবং ঋণের বর্ধিত খরচের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই এই সংকটের পূর্ণ সমাধানের জন্য শুধুমাত্র সুদের হার বাড়ানো যথেষ্ট নয়। দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত এই মুহূর্তে ঋণের অপ্রতুলতা এবং উচ্চ সুদের হারের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে। এর ফলে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারছে না, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই কঠিন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সরকারকে অবশ্যই সুদের হার, বিনিয়োগ এবং মূল্যস্ফীতির মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করতে হবে।

এ ছাড়া সুদের হার কমলে উৎপাদন খরচ কমে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে আরও ভালো অবস্থানে যেতে পারে। নতুন বিনিয়োগ হলে নতুন নতুন শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে বা বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ হয়। এর ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা (এসএমই) কম সুদে ঋণ পেলে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করে দ্রুত কর্মসংস্থান বাড়াতে পারে। তাই একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাংক সুদহার ও কাঠামোগত সংস্কার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ছে।

তারা আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মতো সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে, যাতে তারা বাজার ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা এবং শুল্ক নীতিতে সামঞ্জস্য আনতে পারে। একই সঙ্গে সরকারকে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে, দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ জরুরি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সুরক্ষার জন্য বিশেষায়িত ‘সুদ ভর্তুকি’ বা কম সুদের সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত।

এ বিষয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভনর্র ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক করেন শিল্পোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের একটি উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল। ওই বৈঠকে ব্যবসায়ীরা জানায়, বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা ধরে রাখা, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুদের হার ধীরে ধীরে কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে (এক অঙ্ক) নামিয়ে আনতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভনর্র ড. আহসান এইচ মনসুর ওই বৈঠকে উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের বক্তব্য সমর্থন করে জানিয়েছেন, নীতি সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসবে, যা আগামী মুদ্রানীতিতেই প্রতিফলিত হতে পারে বলে আশা করছি।

তিনি বলেন, সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আগামী অর্থ বছরে যাতে কার্যকর করা যায় সেই চেষ্টাও চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আশা করছি, যৌক্তিক সুদহার নির্ধারণ করা যাবে।

এ ছাড়া, সুদের হার কমিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ ও আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে সহ-সভাপতি প্রার্থী ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ শামীম।

মাসরুর রিয়াজ বলেন, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় হতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়ার কারণে অর্থনীতিতে এখন ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে রিজার্ভ সঙ্কট কেটে যাচ্ছে। কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিও বাড়তে শুরু করেছে। তবে এখনো পুরোপুরি আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়নি। নতুন বিনিয়োগ আনতে হলে বেসরকারিখাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানো জরুরি বিষয়। ব্যবসায়ীরা সুদ কমানোর কথা বলছেন। অন্যদিকে এখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ও রয়েছে।

তিনি বলেন, অর্থনীতিতে এসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য একটি যৌক্তিক সুদহার নির্ধারণ করতে হবে। শিল্পখাতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন৷ এর সঙ্গে শিল্প-কারখানার অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে ৫-৭ বিলিয়ন ডলার। তাতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ব্যবসায়ী নেতা সাকিফ শামীম বলেন, নতুন বিনিয়োগ আনতে হলে ব্যাংক ঋণের সুদ কমাতেই হবে। অন্যথায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটাতে সুদের হার কমাতে হবে। অগ্রাধিকার খাত, বিশেষ করে কৃষি, এসএমই (ছোট ও মাঝারি শিল্প), স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, আবাসন, গার্মেন্টস এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি বলেন, অনেক ব্যবসায়ী ৯ শতাংশের কম সুদ বিবেচনায় ঋণ নিয়ে এরই মধ্যে শিল্প স্থাপন করেছেন। কিন্তু এখন সুদ গুনতে হচ্ছে ১৪-১৫ শতাংশ। নীতি সুদহার এভাবে বাড়তে থাকলে আগামীতে ঋণের খরচ আরও বেড়ে সামগ্রিকভাবে সংকট তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে বাংলাদেশ। যারা উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, তারা ঋণের ভারে খেলাপি হয়ে পড়বেন।

সাকিফ শামীম আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একটি অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় দৈনন্দিন ব্যবহার্য দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানূষের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য হচ্ছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। এই উচ্চ সুদের হারের কারণে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন ব্যহত হচ্ছে তেমনি অর্থনীতির গতিও হারাচ্ছে। নতুন চাকরি তৈরি না হওয়ায় দেশের অর্থনীতি গতি হারাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের নীতিনির্ধারকদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, অর্থনীতিকে সচল রাখতে বিনিয়োগবান্ধব একটি যৌক্তিক ও ভারসাম্যপূর্ণ সুদের হার নির্ধারণ করা।

তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকট শুরু হওয়ার আগে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশ এ সীমিত ছিল। সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথমে এই সীমা তুলে দেয় এবং পরে ‘স্মার্ট’ নামের একটি পদ্ধতি চালু করে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই পদ্ধতিও বাতিল করে বর্তমানে ঋণের সুদের হারকে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ, ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার বেড়ে বর্তমানে ১৩.৫৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সুদের হারের এই বৃদ্ধি বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে, কারণ এত বেশি সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করা উদ্যোক্তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামগ্রিকভাবে, বর্ধিত সুদের হার এই উৎপাদন খরচকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

জিসিজি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।