জ্বালানিসংকট, মূল্যবৃদ্ধি, ঋণের উচ্চ সুদহার, ঋণের কিস্তি পরিশোধে কড়াকড়ি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বেতন-ভাতা না দিলে শিল্পমালিকদের কারাগারে পাঠানোর হুমকিতে শঙ্কিত দেশের শিল্পকারখানার মালিকরা। নিরাপত্তাহীনতা, মামলা-হামলাসহ নানানরকম সংকটে শিল্প উৎপাদন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক থেকে দেড় মাস ধরে চলা প্রকট গ্যাস সংকটে দেশের রপ্তানিনির্ভর ও স্থানীয় টেক্সটাইল মিল এবং পোশাক খাতসহ অনেক খাতের কারখানার উৎপাদন আংশিক অথবা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে গড়ে তোলা শিল্পকারখানা নিয়ে এখন চরমভাবে শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, নতুন করে বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। শিল্পবিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিল্পকারখানা গলাটিপে মেরে ফেলা হচ্ছে। চাঁদাবাজি চলছে। দুর্নীতিও শেষ হয়নি। তবে দেশের অর্থনীতি কীভাবে বাঁচবে, সেটি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। নতুন কর্মসংস্থান না হলে কোথায় যাবে এই দেশ- এমন প্রশ্নও তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। উপদেষ্টার প্রতিশ্রতির পরও শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ বাড়েনি। অনেক শিল্পকারখানার উৎপাদনে ধস নেমেছে। চলতি মূলধন সংকুচিত হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ঈদুল আজহার আগে শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে গত রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা জাতির জন্য অনেক বড় ক্ষতি। আজকে ২০২৫ সালে শুধু শিল্প না, শিল্পোদ্যোক্তাদেরও মেরে ফেলা হচ্ছে। আমি মনে করি এটা একরকম ষড়যন্ত্র। উটপাখি বিপদের সময় যেভাবে বালুর মধ্যে মাথায় লুকায়; আমাদের উপদেষ্টারা উটপাখির মতো হয়ে গেছেন। মনে হয় তাঁরা কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। প্রতিনিয়ত কারখানা বন্ধ হচ্ছে। কিছুদিন পর মানুষ রাস্তায় নামবে। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। বিটিএমএর সভাপতি আরও বলেন, বিডা নাকি বিদেশি বিনিয়োগকারী নিয়ে আসবে এমন বড় বড় গল্প শোনানো হচ্ছে। বিদেশ থেকে একজন শিল্পপতিকে এনে আমাদের সঙ্গে পার্টনারশিপে নামিয়ে দেন, ব্যবসা করুক। বাংলাদেশে ব্যবসার খরচ অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। আমরা একটা অস্বস্তিকর পরিবেশে আছি।
বিসিআইয়ের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, সরকার যদি প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখতে না পারে তাহলে শিল্পমালিকরা দায়ভার কেন নেবেন? সরকার থেকে শিল্পমালিকদের ধমক দেওয়া হচ্ছে, নির্ধারিত সময়ে বেতন-ভাতা না দিলে মালিকদের জেলে দেবে। গ্যাস দেবেন না; ব্যাংকের সুদ বাড়াবেন আবার গ্যাসের বিলও দিতে হবে; ব্যাংকের ঋণও পরিশোধ করতে হবে। কোথা থেকে দেব। দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের জেগে ওঠা উচিত।
ব্যবসায়ীরা জানান, হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করে গড়ে তোলা শিল্পকারখানায় ব্যাংকগুলোরও বিনিয়োগ রয়েছে। সরকারের রোষানলে পড়লে তাঁদের শিল্প-ব্যবসা বন্ধ হলে বিপুল জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থান হারাবে। ব্যাংকগুলো কিস্তির টাকা পাবে না। চলতি অর্থবছরের ১০ মাস জুলাই থেকে এপ্রিলে দেশি-বিদেশি নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রকল্পের সংখ্যা ৮১৪। এসব প্রকল্পে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ২৭ হাজার ৯৩৬ কোটি ৮৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এ হিসেবে চলতি অর্থবছরের দুই মাস বাকি থাকলেও গত অর্থবছরের চেয়ে নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রকল্প পরিস্থিতিও নেতিবাচক।
এ বিষয়ে বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। এর মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের ক্রমাগত অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, ডলারের সংকট, ব্যাংক সুদের হার ১৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদশের রপ্তানি পণ্যের ওপর আরোপিত অতিরিক্তি ৩৭ শতাংশ শুল্ক, রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনার অস্বাভাবিক হ্রাস এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কারখানা মালিকরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এ বিষয়ে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর রিয়াজ বলেন, চ্যালেঞ্জিং সময়ে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করা হলে উৎপাদনমুখী খাতে পণ্য উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে। কমবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। নতুন বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্যাসের দাম বাড়লে অনেক শিল্প বন্ধ হবে, তখন মন্দ ঋণ বাড়বে।
এসআই