বড় ঋণের সহায়তায় কমিটি গঠনের সাড়ে পাঁচ মাসেও কোনো অগ্রগতি নেই। সময় চলে যাচ্ছে যাচাই-বাছাইয়ে।
ফলে বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলো অনিচ্ছাকৃত খেলাপি হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাঙ্ক্ষিত সহায়তা না পেয়ে আরো রুগ্ণ হয়ে পড়ছে। কোনো কোনোটি বন্ধ হয়ে বিপুলসংখ্যক কর্মীর চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় গতি হারানোর পেছনে সদ্য সাবেক কমিটির প্রধান মেজবাউল হকের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, দেশের শিল্প খাত চরম সংকটের মুখে রয়েছে।
ক্ষমতার পালাবদল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, ঋণের উচ্চসুদ, ডলারের লাগামহীন দর, আস্থাহীনতাসহ নানান কারণে মন্দা সময় পার করছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প খাত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের শর্তের খড়্গ। সংস্থাটি ছয় মাসের পরিবর্তে ঋণের কিস্তি শোধের সময়সীমা তিন মাস করায় খেলাপি ঋণ এক লাফে অনেক বেড়ে গেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন প্রকৃত শিল্পোদ্যোক্তারা।
ব্যবসায় মন্দার কারণে তাঁরা ঠিকমতো কিস্তি দিতে পারছেন না। এতে তাঁদের আইনের মারপ্যাঁচে ফেলে খেলাপি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। সময়ের আগেই খেলাপি হয়ে পড়ায় অনেকের শিল্প-কারখানা চালু রাখা, ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া বা স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখাই কঠিন হচ্ছে। এ ঘটনা ঘটেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক শিল্প গ্রুপের ক্ষেত্রেও। যাদের উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেশি, যেখানে বিপুলসংখ্যক লোক কাজ করে এবং তারা সরকারকে মোটা অঙ্কের রাজস্ব দেয়।
এসব প্রতিষ্ঠানের অনিচ্ছাকৃত খেলাপি হয়ে পড়ায় তাদের শিল্প এগিয়ে নেওয়া এখন দুরূহ হয়ে পড়ছে। বিষয়টি সরকারকেও ভাবিয়ে তোলে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে এমন বড় বড় শিল্প গ্রুপের অনিচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের পর্যালোচনা করে তাদের বিশেষ নীতি সহায়তা দিতে একটি কমিটি করে দেয়। ওই কমিটির কাজ হলো কারা সত্যিকার অর্থে নীতি সহায়তা পাওয়ার যোগ্য—এমন ঋণগ্রহীতা চিহ্নিত করা, যাতে তাদের ঋণ সহায়তা দিলে তারা শিল্প-কারখানা স্বাভাবিক রাখতে পারবে।
কমিটি গঠনের পর তারা ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাদের আবেদন করার আহবান জানায়। এতে বিপুল সাড়া পড়ে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ হিসাবে গত সাড়ে পাঁচ মাসে আবেদন জমা পড়েছে এক হাজার ২৫৩টি। এর মানে, অন্তত সাড়ে ১২শ শিল্প প্রতিষ্ঠান অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হয়ে এখন নীতি সহায়তা চাচ্ছে। এদের মধ্য থেকে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করে নীতি সহায়তা দেওয়া হলে এসব প্রতিষ্ঠান ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এবং অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, কমিটি গঠনের সাড়ে পাঁচ মাসেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। তারা এ সময় ১৩টি সভায় মিলিত হলেও মাত্র ১০০টি ফাইল যাচাই-বাছাই করেছে। কিন্তু চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতে পারেনি একটিরও। বলতে গেলে কাজের কাজ তেমন হয়নি।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক গ্রুপের বন্ধের ঝুঁকি বাড়ছে। তারা নানাভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও এ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সমাধান পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, কমিটি মিটিংয়ের পর মিটিং শেষে যে শ খানেক ফাইল বাছাই করেছে, সেগুলো পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছে। এখন ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে শর্ত পরিপালন করে চূড়ান্ত পুনর্গঠন (পুনঃতফসিল) অনুমোদন হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও বড় ঋণ পুনর্গঠন (পুনঃতফসিল) বাছাই কমিটির সদস্যসচিব শাহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, ‘এরই মধ্যে ১০০টিরও বেশি কেস আমরা বাছাই করেছি। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছে হস্থান্তর করেছি। এখন ব্যাংক ও গ্রাহক মিলে শর্ত পরিপালনসাপেক্ষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। আর বাকি কেসগুলো আমরা দ্রুত বাছাইপ্রক্রিয়া সম্পন্নের কাজ করছি। সার্বিক বিষয়টি মিডিয়াতে জানানো হবে। ’
ঋণদাতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) এসব আবেদন চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করার কথা। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত কোনো আবেদনেরই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। কিছু ব্যাংক সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের ঋণ পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিলেও অন্য ব্যাংকগুলো ঝুলিয়ে রেখেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যেসব গ্রাহকের ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে, কেবল তাঁরাই পুনর্গঠনের আবেদন করতে পারবেন। ওই সময় দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এর তিন মাস পর গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকায় ঠেকে। খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায় ২০.২০ শতাংশে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আরো ৭৪ হাজার ৫৯১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে। গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের ২৪.১৩ শতাংশই এখন খেলাপি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্য কাজের ধীরগতির জন্য নানা যুক্তি দেখাচ্ছেন। তাঁরা জানান, গত ৩০ জানুয়ারি ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে দেওয়া চিঠিতে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলো ভঙ্গ করেও অনেক গ্রাহক কমিটির কাছে আবেদন করেছেন। আবার খেলাপি নন, এমন অনেক গ্রাহকও নিজেদের ঋণ পুনর্গঠন করে মেয়াদ বৃদ্ধি করতে চাচ্ছেন। এ কারণে কমিটির পক্ষে আবেদন যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি বলেন, ‘হাজারের বেশি আবেদন একটি কমিটির পক্ষে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই কঠিন। এ জন্য কমিটির সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়েও ভাবা হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের স্বার্থেই খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। দেড় দশক ধরে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, সেগুলো এত দিন ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। এখন আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের অডিট ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে সেসব ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। তবে যেসব গ্রাহক সত্যিকার অর্থেই যৌক্তিক কারণে খেলাপি হয়েছেন, আমরা তাঁদের সুযোগ দিতে চাই। ’
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ জানিয়েছেন, নানামুখী চাপ ও ব্যাবসায়িক সংকটে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি ঘাটতি, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদহার, কঠোর মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এই ছয়টি বড় ধাক্কায় ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি থেমে গেছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নের বিকল্প নেই। দেশের স্বার্থেই ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ জরুরি। সেই পরিবেশ তৈরি করতে সরকারের প্রতি অনুরোধও করেছেন তিনি।
এদিকে শিল্প গ্রুপগুলোকে বিশেষ সহায়তা দিতে গঠিত কমিটির ধীরগতির পেছনে কমিটির তৎকালীন আহবায়ক বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের তখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হকের নিষ্ক্রিয়তা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও তিনি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় বদলি হয়েছেন। এখন সেই দায়িত্ব পালন করছেন নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, যে কমিটি ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করবে, তার প্রধান করা হয়েছিল এমন এক ব্যক্তিকে, যিনি এরই মধ্যে রিজার্ভ চুরিতে জড়িত থাকার দায়ে দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন। কমিটির সাবেক প্রধান মেজবাউল হকের বিরুদ্ধে রিজার্ভ চুরির আলামত নষ্ট করার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ইতিপূর্বে বহু অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
গত বছর দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরসহ ১২ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দায় পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। সিআইডির তদন্তে যেসব কর্মকর্তার দায় চিহ্নিত হয়েছে তাঁদের মধ্যে মেজবাউল হকও একজন।
এ ছাড়া মেজবাউল হকের বিরুদ্ধে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস নগদের অনুমোদন, বিনিময় অ্যাপ চালুর মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা ও ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করার অভিযোগ রয়েছে।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
এসআই