আগামী বছর (২০২৬ সাল) বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ করবে। এই উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ দুটোই বয়ে আনবে।
তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কারোপের কারণে দেশীয় উদ্যোক্তারা এখন চাপের মুখে পড়েছেন। কিন্তু এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেই চাপ সামাল দেওয়া আরও কঠিন হবে। তবে উত্তরণের পরও যেহেতু তিন বছর সময় পাওয়া যাবে, সে কারণে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। এজন্য এলডিসি উত্তরণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা, বেসরকারি খাতের ঋণের সুদ হার স্থিতিশীল রাখা এবং রপ্তানির বৈচিত্র্যকরণ জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণে অর্থনৈতিক কূটনীতি শক্তিশালীকরণ, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলা এবং কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় জোর দিতে হবে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও রপ্তানির সঠিক তথ্য নিশ্চিত করা এবং আর্থিক ব্যবস্থায় সংযম আনা প্রয়োজন। সরকার ইতোমধ্যে ‘স্মুথ গ্র্যাজুয়েশন স্ট্রাটেজি’ তৈরি করেছে, যেখানে বিভিন্ন সুপারিশ রয়েছে। এগুলো দ্রুত অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। এলডিসি উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য বিশ্ব মঞ্চে আত্মমর্যাদা ও সক্ষমতার প্রতীক। সঠিক প্রস্তুতি ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে এই উত্তরণকে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা সম্ভব।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশকে বেশ কিছু নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। যেমন— বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং জাতিসংঘের তহবিলের মতো দাতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে নমনীয় ঋণ এবং অনুদানের সুবিধা হারাবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তে (কনসেশনাল) ঋণ প্রাপ্তির সুযোগও সীমিত হয়ে যেতে পারে। সুদের হার এবং পরিশোধের শর্তাবলী আরও কঠোর হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং অনুদান কমে যেতে পারে, যা দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়নে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে মেধাস্বত্ব অধিকার (ট্রিপস) চুক্তি পরিপালন। ট্রিপস চুক্তির কঠোর বিধিমালা মেনে চলতে হবে, যা ওষুধ শিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
তারা আরও বলেন, বর্তমানে এলডিসি হিসেবে এই শিল্প কিছু ছাড় পায়। কিন্তু এলডিসি উত্তরণের পর রয়্যালটি পরিশোধের মতো বিষয়গুলোয় চাপ সৃষ্টি করতে পারে। শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানোর পর দেশীয় পণ্যকে আন্তর্জাতিক বাজারে সরাসরি প্রতিযোগিতা করতে হবে, যা রপ্তানি বৈচিত্র্য না থাকলে চ্যালেঞ্জিং হবে। উন্নত দেশগুলো থেকে ক্রেতা এবং ভোক্তারা শ্রম ও পরিবেশগত মানদণ্ড পূরণের ওপর আরও বেশি জোর দেবে। তাই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং উত্তরণের সুযোগগুলো কাজে লাগানোর জন্য এখনই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। এজন্য যা করতে হবে— উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধি, ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি, বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ব্যবসা পরিচালনার খরচ কমাতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি হ্রাস করে একটি স্বচ্ছ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে, লজিস্টিকস ব্যবস্থার উন্নয়ন, পরিবহন ও লজিস্টিকস অবকাঠামোর উন্নয়ন করে পণ্য রপ্তানির খরচ কমাতে হবে। বন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘এলডিসি উত্তরণে প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে। উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ’
তিনি বলেন, ‘নতুন সংকট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কারোপ। এ অবস্থায় আগামী বছর বাংলাদেশ এলডিসি দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে এলডিসি দেশ হিসেবে এতদিন যেসব দেশে পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া গেছে তা সংকুচিত হয়ে আসবে। এই সংকট উত্তরণে এখনই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আমরা এ বিষয়ে বলছি। আমাদের অবকাঠামোগত সমস্যা প্রকট, বিশেষ করে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও বন্দরে নানারকম সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা দূর করতে হবে। ’
এফবিসিসিআই নির্বাচনে সহ-সভাপতি প্রার্থী ও ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালটি সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ শামীম বাংলানিউজকে বলেন, ‘আগামী বছর বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়ে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ঠিকই। কিন্তু এটি আমাদের জন্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ দুটোই বয়ে আনবে। ফলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য এখনই সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে জোরেশোরে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। ’
তিনি বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণের পর অনেক বাণিজ্যিক সুবিধা কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই সেই ঝুঁকি মোকাবিলায় রপ্তানি আরও প্রতিযোগিতামূলক করা, রাজস্ব আদায় বাড়ানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, বাণিজ্য সহায়তা সহজীকরণ এবং নতুন বাজার খুঁজে বের করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। রপ্তানি আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে, যা বর্তমানে এলডিসি (স্বল্পোন্নত) সুবিধা দিয়ে সহজ হয়েছে। ’
সাকিফ শামীম এলডিসি হতে উত্তরণের ফলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। কেননা, এলডিসি সুবিধা কমে যাওয়ায় কিছু ক্ষেত্রে সরকারের আয়ও কমতে পারে। এছাড়া নতুন বাজার খুঁজে বের করা এবং সেখানে নিজেদের পণ্য ও সেবা বাজারজাত করার বিষয়ে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
ব্যবসায়ী এই নেতা বলেন, ‘সাড়ে ৪ কোটি ব্যবসায়ীরাই এদেশের অর্থনীতির প্রাণ। মোট দেশজ উৎপাদনের ৮০ শতাংশ আসে ব্যবসায়ীদের হাত দিয়ে। তাই এলডিসি উত্তরণের প্রধান চ্যালেঞ্জটিও নিতে হবে ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরাই প্রথম চাপের মুখে পড়বেন। বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পাঁচ বছর পিছিয়ে দিলে ভালো হয়। কিন্তু সেটি এখন আর সম্ভব নয়। ’ সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হলে এফবিসিসিআইয়ের সকল পর্যায়ের ব্যবসায়ীদেরকে সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান। কোনো ব্যবসায়ী যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হন সে বিষয়টি সামনে রেখে কাজ করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সাকিফ শামীম আরও জানান, এলডিসি উত্তরণের পর বিশ্ববাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার, বিভিন্ন খাতের বাণিজ্যিক প্রণোদনা, জিএসপি-সহ নানা সুবিধা রহিত হবে এবং এর সঙ্গে সার্বিক রপ্তানির ওপর চাপ পড়বে। এই উত্তরণ দেশের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জ, ঠিক তেমনি কিছু সুযোগ নিয়ে আসবে। তবে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় এবং সুযোগগুলো কাজে লাগাতে প্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে তৈরি পোশাক এবং ওষুধ শিল্পের ওপর এর বড় প্রভাব পড়তে পারে। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার অর্থ হলো অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধাগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া। রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখে এমন পোশাক খাত, গ্র্যাজুয়েট-পরবর্তী সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোয় ৮-১২ শতাংশ শুল্কের সম্মুখীন হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং অনুদান কমে যেতে পারে, যা দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়নে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে মেধাস্বত্ব অধিকার চুক্তি পরিপালন—ট্রিপস চুক্তির কঠোর বিধিমালা মেনে চলতে হবে, যা ওষুধ শিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
এছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব (সিইপিএ) এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার জন্য আলোচনা দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা মেনে বাণিজ্য নীতিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বিনিয়োগ নীতি এবং প্রণোদনাগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে। বিশেষ করে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে উন্নত অবকাঠামো, দক্ষ মানবসম্পদ, সহজ ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। বর্তমানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব অবকাঠামোগত ও নীতিগত দুর্বলতা রয়েছে, সেগুলো কাটিয়ে ওঠা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, পণ্য বৈচিত্র্যকরণ, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এলডিসি উত্তরণে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ এবং পিটিএ করার উদ্যোগ নিতে হবে। যেহেতু প্রণোদনা উঠে যাবে, সেহেতু এলডিসি উত্তরণের পর ব্যবসায়ীদের বিকল্প উপায়ে সহযোগিতা দিতে হবে। ’
জিসিজি/এমজে