উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, যান্ত্রিক ক্রটি, কর্তৃপক্ষের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও বিপুল পরিমাণ চিনি অবিক্রিত থাকাসহ নানা সমস্যার কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ লোকসান গুণতে হচ্ছে এই চিনিকলটিকে।
চিনিকলের দেওয়া এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক দশকে পঞ্চগড় চিনিকলের লোকসানের পরিমাণ দেড়শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
পঞ্চগড় চিনিকল সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৫-৬৯ সালের সরকারের সময়ে দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের ধাক্কামারা এলাকায় ৫৫.৫৫ মিলিয়ন টাকা ব্যয়ে ১৯৮.৪৬ একর জমির উপর স্থাপন করা হয় পঞ্চগড় সুগার মিলস লিমিটেড।
১৯৬৯ সাল থেকে পরীক্ষামূলক আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন শুরু হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৮ হাজার ৫৩৬ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদিত হতো এই চিনিকল থেকে। কিন্তু বর্তমানে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে লোকসান গুণছে কারখানাটি।
১৯৯৪-৯৫ অর্থ বছরে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৬১২ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদিত হয়েছিল। সর্বশেষ ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে ১৪ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে। তারপর থেকেই চলছে লোকসান। ২০১১-১২ অর্থ বছরে ২৩ কোটি টাকা লোকসান হয়।
২০১২-১৩ অর্থ বছরে ৭ হাজার ৫শ’ একর জমিতে ৭২ হাজার মেট্রিক টন আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ৭০ হাজার ৯৬৯ মেট্রিক টন আখ উৎপাদিত হয়। চিনি ৪ হাজার ৩২০ মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৪ হাজার ২৩১ মেট্রিক টন উৎপাদিত হয়। ওই অর্থ বছরে লোকসান হয় ২৬ কোটি টাকা।
২০১৩-১৪ অর্থ বছরে ৭ হাজার ৫শ একর জমিতে ৯০ হাজার মেট্রিক টন আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে ৯৪ হাজার ৯২১ মেট্রিক টন আখ উৎপাদিত হয়। চিনির লক্ষ্যমাত্রা ৭ হাজার মেট্রিক টন হলেও তা লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৬ হাজার ২৫১ মেট্রিক টন উৎপাদিত হয়।
২০১৪-১৫ অর্থ বছরে আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৮৫ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হলে আখ উৎপাদন হয় ৬১ হাজার ১৫৬ মেট্রিক টন।
চিনির লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন হলেও উৎপাদিত হয়েছে ৩ হাজার ৫১৮ মেট্রিক টন।
২০১৫-১৬ অর্থ বছরে সাড়ে ৪ হাজার একর জমিতে আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৭০ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হলে আখ উৎপাদন হয় ৪৮ হাজার ৭১৭ মেট্রিক টন। চিনির লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন হলেও উৎপাদিত হয়েছে ২ হাজার ৭৫৭ মেট্রিকটন।
চলতি ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৮০ হাজার মেট্রিকটন আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখান থেকে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন।
বর্তমানে গত অর্থ বছরে উৎপাদিত ২ হাজার ৭৫৭ মেট্রিক টন চিনির মধ্যে ২ হাজার ২৫০ মেট্রিকটন ও চলতি অর্থ বছরের এখন পর্যন্ত উৎপাদনের ৩ হাজার ১০২ মেট্রিকটন সহ মোট ৫ হাজার ২৬০ মেট্রিকটন চিনি গুদামজাত রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩৩ কেটি টাকা।
পঞ্চগড় জেলার আখ চাষ উপযোগী ৩০ হাজার একর জমির মধ্যে ১০ হাজার একর জমি আখ চাষের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু পুরনো জাতের আখে চিনি রিকোভারি হার ব্যাপক অংশে কমেছে। সেইসঙ্গে আখ চাষে চাষিদের লোকসান হওয়ায় চাষিরা অন্য ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে ৬০ টাকা দরে চিনি বিক্রির বিপরীতে চিনিকলে এক কেজি চিনির উৎপাদন খরচ পড়ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত।
দীর্ঘদিনে একটানা এই লোকসানের কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারিরাও পাচ্ছেন না তাদের পেনশনের টাকা। এতে দেশের প্রাচীন এই চিনিকলটি দিন দিন প্রাণ হারাতে বসেছে। সেইসঙ্গে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কর্মকর্তা, কর্মচারী, স্থায়ী ও মৌসুমী শ্রমিকসহ মোট ৮২৬ জন ব্যক্তির পরিবারও এগিয়ে যাচ্ছে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে।
প্রতি বছর আখ স্বল্পতায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে চিনিকলটি বন্ধ হয়ে যায় এবং সারা বছরের প্রায় ১০ মাসই বন্ধ থাকে। সংক্ষিপ্ত এই মৌসুমে উৎপাদিত মুনাফা থেকে মৌসুমী এবং স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়া লোকসানের একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিস্টরা।
পঞ্চগড় চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমদাদুল হক বলেন, ‘আখ স্বল্পতার কারণে মাত্র দুই মাস চিনিকল চলে। সেখান থেকেই পুরো বছর কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনসহ অন্যান্য সব খরচের কারণে এই লোকসান হচ্ছে। তবে আখ চাষ বাড়ানোর জন্য আমরা চাষিদের বিভিন্ন ভাবে উদ্বুদ্ধ করছি। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা প্রক্রিয়া চলছে। সেইসঙ্গে সুগার-বিট দিয়ে চিনি উৎপাদনের জন্য সুগার-বিট চাষের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এছাড়া বৃহৎ এই চিনিকলটিকে বহুমুখী ব্যবহারের প্রস্তাবনা সরকারের কাছে পেশ করা হবে বলে জানান তিনি। ”
বাংলাদেশ সময়: ০৫১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৭
আরএ