ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

গোপন গুদামে কারবার বন্ড চোরাকারবারিদের

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৯ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৯
গোপন গুদামে কারবার বন্ড চোরাকারবারিদের ট্রাকসহ পণ্য জব্দের ফাইল ছবি

ঢাকা: বন্ডের সুবিধায় আমদানি করা কাগজ পুরান ঢাকার নয়াবাজারের গোপন গুদামে মজুদ করে চোরাকারবারিরা। এসব কারবারির নেই কোনো বৈধ প্রতিষ্ঠান। বৈধ পাইকারি ব্যবসায়ীদের আড়ালে রাতের আঁধারে চোরাই পণ্য এনে কম মূল্যে বিক্রি করে দেন তারা। হাতবদল হয় শত কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির কাগজ-পণ্য।

অবৈধ কারবার নির্বিঘ্ন রাখতে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে পাহারা দেয় রাত জেগে। প্রশাসনের লোকজন নয়াবাজারে গেলেই সতর্ক হয়ে যায় তারা।

এমনকি সরকারি লোকজন অভিযান পরিচালনা করতে গেলে সবাই মিলে তাদের বাধাও দেয়, সৃষ্টি করে বিভ্রান্তি। এরই ফাঁকে অন্যরা সরিয়ে ফেলে চোরাই পণ্য।

নয়াবাজারে অভিযানকারী ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তাদের ওপর হামলার অভিযোগে জামাল হোসেন নামে এক শীর্ষ চোরাকারবারিকে গ্রেপ্তারের পর এমনই তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। ঘটনার তিন মাস পর গত শনিবার (২৭ জুলাই) ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে জামালকে গ্রেপ্তার করে। রোববার (২৮ জুলাই) ঢাকার মহানগর হাকিম আদালত তাকে এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন। মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) তাকে ফের আদালতে উপস্থাপন করা হবে।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অত্যন্ত চতুর চোরাকারবারি জামাল তার চোরাই কারবারের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে রিমান্ডে মুখ খোলেননি। তবে ছোট গুদাম ভাড়া নিয়ে শুল্ক ফাঁকির কাগজের পণ্য বিক্রির কথা স্বীকার করেছেন। কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপর হামলায় কারবারিদের সঙ্গে শ্রমিকরাও অংশ নিয়েছেন বলে জানান আসামিরা।

ডিবি পুলিশের পরিদর্শক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘কাস্টমস বন্ড কর্মকর্তাদের ওপর হামলার ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় দায়ের মামলাটির তদন্তভার সম্প্রতি ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। ঘটনার পর থেকেই আসামি জামাল পলাতক ছিল। গত শনিবার শান্তিনগর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে রোববার আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। ’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হামলায় অংশ নেওয়ার কথা স্বীকার করলেও চোরাকারবারের ব্যাপারে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়নি জামাল। ’

তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ‘জামালকে নিয়ে হামলার ঘটনায় মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে আরেকজন বন্ডের পণ্যের চোরাকারবারি আছেন, যার নাম মাহফুজুর রহমান। মাহফুজ ও জামালই হামলায় নেতৃত্ব দেয়। ’

ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সহকারী কমিশনার আল আমিন বলেন, ‘জামাল একজন শীর্ষ চোরাকারবারি। নয়াবাজারে ছোট ছোট গোপন গুদামে বন্ডের সুবিধায় আমদানি করা কাগজ-পণ্য মজুদ করে বিক্রি করে এরা। এর ফলে রাষ্ট্র যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি দেশীয় কাগজ উৎপাদনকারীরা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে। এরা প্রকৃত পাইকারি ব্যবসায়ীদের আড়ালে বেনামে এই কারবার করে। ছোট ছোট গুদাম থাকলেও এদের ব্যবসায়ে শত কোটি টাকার লেনদেন হয়। ’

নয়াবাজার ও আশপাশে শুল্কমুক্ত বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধায় আমদানি হওয়া কাগজ-পণ্য চোরাইভাবে বিক্রির তথ্য পেয়ে গত ১৭ এপ্রিল রাতে সেখানে অভিযানে যান ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা। উপকমিশনার রেজভী আহম্মেদ ও সহকারী কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফয়সালের নেতৃত্বে দুটি প্রিভেন্টিভ দল ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশের একটি গুদামে প্রচুর পরিমাণে কাগজ-পণ্য পান। এরপর নয়াবাজার মোড় এলাকায় ডুপ্লেক্স বোর্ডভর্তি তিনটি কাভার্ড ভ্যান আটক করেন তারা। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা ওই কাগজ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অবস্থিত ‘ভি টেক প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামের বন্ডেড প্রতিষ্ঠান চোরাই পথে বিক্রির জন্য নয়াবাজারে খালাস করছিল। চালানটি জব্দ করে অভিযান শেষ করার আগ মুহূর্তে চোরাকারবারিরা হামলা চালায়। ইটপাটকেল, লাঠিসোঁটা নিয়ে তারা আঘাত করলে ছয়জন কাস্টমস কর্মকর্তা আহত হন। কাস্টমসের একটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয় এ সময়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থল থেকে মাহফুজুর রহমান নামে একজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা। ওই সময় হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে গড়িমসি শুরু করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। শেষে মামলা নিলেও আসামির রিমান্ড আবেদন করেননি তদন্ত কর্মকর্তা। পরে পুলিশ আরো তিন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করে।

হামলাকারী মাহফুজ কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মওদুদ হাওলাদারের ঘনিষ্ঠ বলে অভিযোগ করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। সরকারি কর্মকর্তাদের হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আদালতে সঠিকভাবে উপস্থাপন না করায় কয়েক দিনের মধ্যেই ওই আসামিরা জামিন পেয়ে যায়। এসব বিষয় উপস্থাপন করে গত ২১ মে একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশ করা হলে মামলাটির তদন্তভার কোতোয়ালি থানা থেকে ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়।

ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা জানান, জামালকে গ্রেপ্তারের পরও ডিবি পুলিশ অনেকটা রাগঢাক করছে। আসামির ঠিকানা ও ছবি চাওয়া হলে বাদীপক্ষকে তা দেয়নি ডিবি।

এদিকে, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্র জানিয়েছে, বন্ড সুবিধায় আনা কাগজ ও কাপড়ের চোরাই কারবারিদের বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। সিআইডি নয়াবাজারের ওপর বিশেষ নজরদারি করছে। গ্রেপ্তার জামাল সেখানকার একজন বড় চোরাকারবারি বলে তথ্য আছে সিআইডির কাছে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপর হামলার আগে সেখানে যেন অভিযান চালানো না যায় সে ব্যবস্থা করে রেখেছিল জামাল, মাহফুজসহ কয়েকজন। সারা রাত পণ্য আনা-নেওয়ার সময় তারা সেখানে লোক পাহারায় রাখে। কেউ অভিযানে গেলেই দ্রুত খবর দেয়। অভিযানকারীদের বাধা দেয়। এ সুযোগে চোরাই পণ্য সরিয়ে ফেলা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১২০৭ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৯
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।