ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সম্পাদকীয়

স্বর্ণশিল্পের সম্ভাবনা ও বিকল্প বিনিয়োগ

আবু আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩
স্বর্ণশিল্পের সম্ভাবনা ও বিকল্প বিনিয়োগ

বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে স্বর্ণ নীতিমালা করা হয়েছে। এর সুফল এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।

আমরা আশা করেছিলাম, বড় বড় শিল্প বা ব্যাবসায়িক গ্রুপ এখানে বিনিয়োগ করবে এবং আমাদের একটি সত্যিকারের স্বর্ণশিল্প গড়ে উঠবে। গণমাধ্যমের সূত্রে জানতে পেরেছি, বসুন্ধরা গ্রুপ দেশে গোল্ড রিফাইনারি স্থাপন করতে যাচ্ছে। এ উদ্যোগ অবশ্যই দেশের স্বর্ণশিল্পের একটি ব্রেক থ্রু হবে।

দেশে স্বর্ণশিল্প কেন গড়ে ওঠা দরকার, সে বিষয়গুলো নীতিনির্ধারকদের অনুধাবন করতে হবে। এরমধ্য দিয়ে অলংকার রপ্তানির একটি বিরাট সুযোগ আসবে এবং অনেক বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া যাবে।

তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, দেশে ‘অল্টারনেটিভ অ্যাসেট হোল্ডিং’ হিসেবে স্বর্ণে বিনিয়োগের চাহিদা তৈরি হয়েছে। সেই চাহিদা পূরণে স্বর্ণশিল্পের বিকাশ দরকার। অনেক মানুষ ইকুইটি, বন্ড বা এফডিআরে স্বস্তি না পেলে বিকল্প হিসেবে গোল্ড কয়েন বা গোল্ড বার ধারণ করতে চায়, কিন্তু পায় না।

আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত স্বর্ণশিল্প বলতে যা বোঝায়, সেটি হচ্ছে স্বর্ণের দোকানদারি, যা অলংকার বিক্রয়ে সীমাবদ্ধ। এটিকে ঠিক গোল্ড ইন্ডাস্ট্রি বা স্বর্ণশিল্প বলা যায় না। ছোট-বড় হাজার হাজার স্বর্ণের দোকান রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। কিন্তু এদের মান নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। থাকলেও সেটি কার্যকর নয়। ফলে স্বর্ণ বিক্রয়ের নামে এক ধরনের ঠকাঠকির ব্যবসা এখানে হয় বলে বহুকাল ধরে মানুষ মনে করে। তাদের মধ্যে স্বর্ণের অলংকার কেনা নিয়ে অবিশ্বাস কাজ করে। এখানে স্বর্ণ কেনা যায়, কিন্তু বিক্রয় করলে উপযুক্ত দাম পাওয়া যায় না। মানে, আমাদের এখানে স্বর্ণের ট্রান্সফার্জাবিলিটি বা বিনিময়যোগ্যতা নেই। বিদেশে যত্রতত্র স্বর্ণ বিক্রয়ের দোকান বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এই পটভূমিতে আমাদের নীতিনির্ধারকদের দেশে গোল্ড রিফাইনারি বা স্বর্ণ পরিশোধন কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দিতে হবে।

আমাদের এখানে কেউ স্বর্ণ বিক্রয় করতে গেলে দোকানদারের মাধ্যমে করতে হয়। এভাবে স্বর্ণ বেচাকেনার পদ্ধতিটি প্রাচীন। এটি দিয়ে গোল্ড ইন্ডাস্ট্রি হবে না। বিদেশে ধনী লোকজন সাধারণত ডলার, গোল্ড, ইকুইটি ও ফরওয়ার্ড মার্কেটে বিনিয়োগ করে। কিন্তু এখানে গোল্ড মার্কেটে বিনিয়োগের ব্যবস্থা নেই। আবার কেউ যদি ২০০ বা ৫০০ গোল্ড কয়েন ক্রয় করতে চায়, তাহলে সে এটি রাখবে কোথায়? এখানে কাস্টডিয়ান সার্ভিস নেই। আমাদের গোল্ড মার্কেট তৈরি করতে হলে স্বর্ণের কাঁচামাল আমদানি করা লাগবে এবং তা পরিশোধনের জন্য রিফাইনারি লাগবে। এসব করতে গেলে বড় আকারের বিনিয়োগ প্রয়োজন। দেশে যাঁদের বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাঁদের এগিয়ে আসতে হবে।

দেশে ৩০ থেকে ৪০টি বড় বিজনেস হাউস রয়েছে। স্বর্ণ নীতিমালা হওয়ার পর আমাদের প্রত্যাশা ছিল এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই এখানে বিনিয়োগ করবেন এবং তাঁরা এই খাতটিকে এগিয়ে নেবেন। এর মধ্যে বসুন্ধরার উদ্যোগটি খুবই ভালো। তারা এ খাতে পাইওনিয়ার হতে যাচ্ছে। স্বর্ণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, স্বর্ণ আমদানি করবে ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক এভাবেই বলে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে স্বর্ণের আমদানি শুল্ক প্রতি ভরিতে দুই হাজার টাকা। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক চার্জ যোগ হয়ে দাঁড়ায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। বছরখানেক আগে এনবিআরের চেয়ারম্যান আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে আমদানি শুল্ক কমানোর পরও স্বর্ণ চোরাচালান কমছে না। কিন্তু কেন চোরাচালান কমছে না বা নীতিমালা ফলপ্রসূ হচ্ছে না, তা পর্যালোচনা করা দরকার।

প্রকৃতপক্ষে দেশে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ চোরাচালান হচ্ছে। আর বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ চোরাচালান হওয়া মানে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাওয়া। চোরাচালানের স্বর্ণ প্রধানত অবৈধ কাজে ব্যবহার করা হয়। যেমন—মাদক আমদানিতে ব্যবহৃত হয়। আবার যেসব ক্ষেত্রে আমদানিতে শুল্ক বেশি রাখা হয়েছে, সেখানে অবৈধ স্বর্ণ ব্যবহার করা হয়। আমাদের ব্যাগেজ রুলেও স্বর্ণ আনা সহজ। কিন্তু স্বর্ণ নীতিমালা করার পরও দেখা যায়, কয়েক বছর ধরে দেশে এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ অবৈধ স্বর্ণ উদ্ধার করে যাচ্ছে। স্বর্ণ নীতিমালা হওয়ার পর এটি হওয়ার কথা ছিল না। এয়ারপোর্ট থেকে এয়ারপোর্টে অবৈধ স্বর্ণ জব্দ, চোরাকারবারি ধরা—এসব বেশির ভাগ দেশেই নেই।

আমার মনে হয়, ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানির যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেটি কাস্টডিয়ান ব্যবস্থা হিসেবে হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু এর আরো বিকল্প থাকা উচিত। আমি মনে করি, সরকারের পক্ষ থেকে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে আলোচনা করা উচিত দেশে স্বর্ণশিল্প গড়ে উঠতে আর কী কী করা প্রয়োজন কিংবা এ ক্ষেত্রে কী কী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

ভারত প্রতিবছর ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অলংকার রপ্তানি করে। তৈরি পোশাকসহ আমাদের মোট রপ্তানির পারিমাণও তাই। আমাদের অর্থনীতির যে অগ্রগতি তার সঙ্গে এটি যায় না। দেশে রপ্তানিমুখী স্বর্ণশিল্প গড়ে উঠলে এ খাতে বিশেষায়িত কারিগর শ্রেণিও তৈরি হবে, যা কর্মসংস্থানেও অবদান রাখবে।

এবার আসি স্বর্ণে বিনিয়োগ প্রসঙ্গে। আমরা যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করি, বিদেশে ধনীদের অনেকেই এই বিনিয়োগ করেন গোল্ড মার্কেটে। বিশ্ববাজার বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, সামনের দিনগুলোতে কাগজের মুদ্রার দাম কমে যাবে এবং স্বর্ণ ও হীরার দাম বাড়বে। কারণ হচ্ছে এগুলো সলিড অ্যাসেট। সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষকে স্বর্ণে বিনিয়োগ বা গোল্ড ধারণ করার সুযোগটা দেওয়া হচ্ছে না। ভারতের লোকজন, চীনের লোকজন স্বর্ণ ধারণ করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তো গোল্ড কয়েন খুঁজেও পাবে না। আবার বাজারে তা চালু হলে দেখা যাবে রাখার জায়গা গড়ে ওঠেনি। কারণ স্বর্ণের বার ঘরে নিয়ে কোনো লাভ নেই। এগুলো ঘরে নেওয়ার বিষয়ও নয় এবং বাইরের দেশে কেউ ঘরে রাখেও না। আমরা যেমন শেয়ার ক্রয় করে ঘরে নিই না, গোল্ড কয়েনের বেলায়ও তাই। এটি কাস্টডিয়ানের অ্যাকাউন্টে থাকতে হয়। শেয়ারের মতোই অর্ডার দিলে ট্রান্সফার হয়ে যাবে। দাম কমা-বাড়ার ওপর নির্ভর করে এর বিনিময় হবে। তাই কাস্টডিয়ান সার্ভিসকে অনেক বেশি উন্নত করতে হবে।

গোল্ড হোল্ডিং হচ্ছে অল্টারনেটিভ অ্যাসেট হোল্ডিং। এটিকে যদি সহজ করে দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশে যাঁরা ধনী মানুষ, বিশেষ করে যাঁরা সুপার রিচ, তাঁরা এদিকে ঝুঁকবেন। মনে রাখতে হবে, অলংকারের জন্য মানুষ স্বর্ণ ধারণ করার দিকে ঝুঁকবে না। কারণ অলংকারের জন্য খুব বেশি স্বর্ণের প্রয়োজনও হয় না। এই সময়ের শিক্ষিত নারীরা অলংকার খুব একটা পরতেও চান না। এখন বৈশ্বিক পদ্ধতিটাই হলো ইকুইটি, বন্ড, গোল্ড, কমোডিটি মার্কেট ও রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করা। আমাদেরও সেভাবেই এগোতে হবে।

এ দেশে অর্থপাচার নিয়ে অনেক কথা হয়। প্রকৃতপক্ষে অর্থ আটকানো সম্ভব নয়। আইনের বেড়া তৈরি করে দেশে অর্থ ধরে রাখা যায় না, বরং বিনিয়োগ সুবিধা বাড়িয়ে অর্থ ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। এ জন্য সামগ্রিক বিনিয়োগ সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি স্বর্ণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রও তৈরি করতে হবে।

স্বর্ণশিল্প বিকাশে বসুন্ধরা গ্রুপের এগিয়ে আসার খবরটি আশা-জাগানিয়া। আমি চাই বসুন্ধরা গ্রুপ দ্রুত বাজারে আসুক। তারা তাদের উৎপাদিত অলংকার, বার ও কয়েন দিয়ে বিশাল শোরুম স্থাপন করুক। সেখানে অলংকার থাকবে, গোল্ড বার থাকবে। বিদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতাও থাকবে। একবার যদি এর সুফল কেউ পায়, দেখা যাবে অন্যরাও আসবে। আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, দেশের উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যে বিকল্প বিনিয়োগের চাহিদা তৈরি হয়েছে, যেটি স্বর্ণশিল্প মেটাতে পারবে। এর পাশাপাশি চোরাচালানও কমে আসবে।

অবৈধ স্বর্ণকে বেআইনি কাজে ব্যবহার কিভাবে বন্ধ করা যায়, সেটি আরেকটি ইস্যু। কিন্তু যারা এসব করবে না, বরং বিশুদ্ধ উপায়ে বিকল্প বিনিয়োগ হিসেবে গোল্ড অ্যাসেট হোল্ড করতে চায়, তাদের জন্য সুযোগটি তৈরি করা হোক। ইকুইটি, বন্ড বা এফডিআর মার্কেট সারা পৃথিবীতেই প্রতিযোগিতামূলক। একটিতে আমার ভালো না লাগলে আরেকটিতে যাব, যাকে শেল্টার বলে। যেমন—এখন বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ঘটছে। মূল্যস্ফীতির আশ্রয় হচ্ছে গোল্ড হোল্ড করা। সারা পৃথিবীতে সবাই তা-ই করে। কারণ মূল্যস্ফীতি হলে কাগজের টাকার মূল্য কমে যায়। তখন লোকে সলিড কোনো অ্যাসেটের দিকে যায়। সলিড অ্যাসেটের মধ্যে স্বর্ণ হচ্ছে প্রথম পছন্দ। বিনিয়োগের জন্য এই ক্ষেত্রটি তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্বর্ণ নীতিমালাটি আরো পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩
জেডএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।