এই রায় সমাজের ভেতর লুকিয়ে থাকা বিকৃতমনাদের, অন্যসব নির্যাতকদের জন্যও এই কড়া বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছে যে, নির্যাতকদের রেহাই নেই। আইনের হাত থেকে নিস্তার নেই।
এই মাইলফলক রায়টি নানা কারণে তাৎপযপূর্ণ। চার বছর আগে নিজের ওপর ঘটা নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতনের মামলার রায় শুনতে মঙ্গলবার (১৮ জুলাই, ২০১৭) ট্রাইব্যুনালের এজলাসকক্ষে হাজির হয়েছিল ১৪ বছর বয়সী আদুরী। সঙ্গে ছিলেন তার মা সাফিয়া বেগম, খালা শাহিনুর বেগম ও মামা মামলার বাদী নজরুল চৌধুরীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা।
রায় ঘোষণার সময় আদুরীর স্মৃতিতে নিশ্চয়ই বারবার হানা দিচ্ছিল ভয়াবহ, বীভৎস, করাল, নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতনের সেইসব লোমহর্ষক মুহূর্ত। দিনের পর দিন মারধর, দিনের পর দিন গরম খুন্তি ও ইস্ত্রির ছ্যাঁকা, ব্লেড দিয়ে শরীরে পোঁচ দেওয়া, মাথায় কোপ, মুখে আগুনের ছ্যাঁকা, খেতে না দেওয়াসহ নানা নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন চলেছে আদুরীর ওপর। নিশ্চয় এসব দু:স্বপ্নময় মুহূর্ত বারবারই ভেসে উঠছিল আদুরীর মানসপটে। এর চেয়ে করাল দু:স্বপ্নময় স্মৃতি আর কীইবা হতে পারে!
সুবিচার পেয়ে সন্তুষ্ট হলেও আদুরীর শিশুমনে নির্যাতনের ভয়াবহ স্মৃতি নিরাময়হীন ক্ষত হয়েই থেকে যাবে। এই ক্ষত চির অমোছনীয়, চির দগদগে। সারাটা জীবন নিরাময়হীন এই মানসিক ক্ষতের যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হবে আদরীকে। এ এক ভয়ানক ট্রমা।
হ্যাঁ, সাক্ষাৎ দানবীই হয়ে উঠেছিলেন মানবী রূপী গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী। তার বাহ্য চেহারাটাই ছিল কেবল মানুষের। অথচ মনটা পিশাচের। আদুরীকে নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হননি তিনি; নির্যাতনের ফলে মরেই গেছে ভেবে তাকে ফেলে এসেছিলেন ডাস্টবিনে। মৃত বেড়ালকে যেমন ফেলে আসা হয় আস্তাকুঁড়ে। এতোটাই নির্মম হৃদয়হীন এই গৃহকর্ত্রী। একটিবার বিবেক জেগে ওঠেনি তার। একটিবার তার বর্বর কুটিল মন ক্ষান্ত হয়নি, মুহূর্তের জন্য থমকায়নি। কসাই যেমন জবাই করা পশুর মাংস কাটে, ছাল ছাড়ায়, নওরীন নদীর কাছেও রক্তমাংসের মানবশিশু আদুরীও হয়ে উঠেছিল সে রকম কিছু।
নওরীন নদীর মনোবিকৃতি আর ধর্ষকামিতা আমাদের বিস্মিত, বিমূঢ় এবং হতবাক করেছে। আমরা যারা স্বাভাবিক মানুষ তারা আদুরীরর ওপর নওরীন নদীর করা নির্যাতনের বীভৎসতায় কেবলি শিউরে উঠেছি। পুরোটাই যেন এক হরর ছবির বাস্তব রূপ।
আদুরী সুবিচার পেয়েছে-- এটা স্বস্তির। তবে সমাজের আনাচে কানাচে এরকম অনেক আদুরী প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। এইসব নির্যাতিত ‘আদুরী’র আর্তনাদ ও করুণ কান্না আমাদের কানে সব সময় পৌঁছায় না। সব নির্যাতনের খবর আমরা পাই না। অনেক সময় অনেক ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। টাকা দিয়ে ‘আপস’ কেনা হয়। ঘুষ দিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে বশ করা হয়। তখন দুর্বল চার্জশিটের ফাঁক গ’লে নির্যাতক ‘নওরীন নদী’রা পার পেয়ে যান।
আশার কথা, এবার তেমনটি হয়নি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হননি। তিনি তার পেশাদারি কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। এজন্য তিনি নি:সন্দেহে ধন্যবাদার্হ। ধন্যবাদার্হ বাদিপক্ষের আইনজীবীরাও। আর যেসব সাধারণ মানুষ শিশু আদুরীকে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে এনে তার জীবন বাঁচিয়েছিলেন মানুষ হিসাবে তাদের স্থান অনেক উঁচুতে। তাদের প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও সাধুবাদ।
আদুরীর ন্যায়বিচার পাওয়ার সংবাদটি আপলোড করার কিছুক্ষণ পরই বাংলানিউজে আরও একটি সংবাদ আপলোড করা হলো—যা আমাদের জন্য অশনিসংকেতই বটে। ‘ সমাজ বিচ্ছিন্নতায় বাড়ছে গৃহকর্মী নির্যাতন’-- শরিফুল ইসলাম জুয়েল-এর লেখা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘গত কয়েক বছর ধরে সারাদেশে গৃহকর্মীর ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। একই সাথে বাড়ছে নির্যাতনের ফলে অপমৃত্যুর ঘটনাও। অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত আড়াই বছরে সারাদেশে কমপক্ষে ১৪৯ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে নির্যাতনের পর হত্যা অথবা আত্মহত্যার ফলে মৃত্যু হয়েছে ৮৬ জনের। ‘
আদুরীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির খবরে আমাদের মনে যে স্বস্তি এসেছিল, শরিফুল ইসলাম জুয়েল-এর রিপোর্ট পড়ার পর সে স্বস্তি কর্পূরের মতো উবে যাবারই কথা। কেননা, ‘‘নির্যাতনকারীকের তালিকায় যাদের নাম দেখা যায় তারা সবাই সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। কেউ ক্রিকেটার, কেউ সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কেউবা আবার নামকরা ব্যবসায়ী। ’’
এরপর আমাদের বলার কীইবা আর থাকে! সম্ভবত আমাদের হৃদয় আর মগজ দুটোতেই পচন ধরেছে—‘‘Something is rotten...’’ শেক্সপিয়রের নাটকের এই উক্তি আমাদের বেলায়ও প্রযোজ্য। তাই আমাদের সমাজদেহের পচন ঠেকানোর কাজটা আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। যেসব নির্যাতকের হাতে লেগে আছে রক্তের দাগ, তাদেরকে জানাতে হবে ঘৃণা—ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবে। নির্যাতকদের ধরিয়ে দিতে হবে। সে যে-ই হোক। সেজন্য চাই আমাদের নিজেদের মনুষত্বের উদ্বোধন---ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনে। আমরা যেন একটিবার আযনায় নিজেদের চেহারার দিকে তাকাই।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৭
জেএম