ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

চবি: কেন এত অস্থিরতা?

মামুনুর রশিদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৪
চবি: কেন এত অস্থিরতা?

১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর। সবুজঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে ১ হাজার ৭৫৪ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির রয়েছে যথেষ্ট সুনাম ও সুখ্যাতি। উপমহাদেশের খ্যাতিমান ভৌত বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ড. অনুপম সেন, ড. আনিসুজ্জামান, আবুল ফজল, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ আলী আহসান, ড. হুমায়ুন আজাদ, মুর্তজা বশীর, ঢালী আল মামুনসহ দেশ বরেণ্য বহু কীর্তিমান মনীষীর পদচারণায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও রয়েছে

বিশ্ববিদ্যালয়টির যথেষ্ট সুনাম। ব্যাঙের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্র সাজিদ আলী হাওলাদার।

এত অগ্রযাত্রার পরেও কেন হঠাৎ থমকে যাবে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি?

পূর্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, ১৯৮৬ সালের ২৬ নভেম্বর ‘জাতীয় ছাত্রসমাজের’ আবদুল হামিদের হাতের কবজি কেটে ছুরির আগায় গেঁথে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেছিল ইসলামী ছাত্রশিবিরের জঙ্গি মিছিল। সেই থেকে একে একে হত্যার রাজনীতির সূত্রপাত হয় ক্যাম্পাসটিতে। রাজনৈতিক সহিংসতায় গত দুই যুগে ১৮ শিক্ষার্থী খুন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। এ সকল হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় দিন দিন ক্যাম্পাসে বেড়েই চলছে অস্থিরতা।

সম্প্রতি গত ১০ সেপ্টেম্বর শিক্ষক বাসে ইসলামী ছাত্রশিবির বোমা মেরে জাতির বিবেকবোধকে স্তব্দ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি শিক্ষার্থীদের চলাচলের প্রধান মাধ্যম শাটল ট্রেনও। বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি আবাসিক হল খুলে দেওয়ার দাবিতে প্রায় দেড় মাস তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে অচল করে রাখে। এর আগে গত ১৪ মে ছাত্রলীগের অর্ন্তকোন্দলের জের ধরে প্রায় দুই সপ্তাহ লাগাতার পরষ্পরবিরোধী অবরোধ কর্মসূচিতে ক্যাম্পাসকে অচল করে রাখে ছাত্রলীগের একাংশ। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এর ভয়াবহতা বুঝতে পেরে বিলুপ্তি ঘোষণা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি। তাতেও থেমে থাকেনি তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। রাতের আঁধারে বারুদের ধোঁয়া, ধারালো অস্ত্রের ঝনঝনানি, আগ্নেয়াস্ত্রের বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল ক্যাম্পাস। ফলে নির্ধারিত সময়ের আগেই টানা তেতাল্লিশ দিন বন্ধ ঘোষণা করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। গত ৯ নভেম্বর ক্যাম্পাস খোলার প্রথম দিনেই আবারো অবরোধের ডাক দেয় ছাত্রলীগের একাংশ। এতে করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম আবারো দারুণভাবে ব্যাহত হয়।

এভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় আর কতদিন চলবে? এর সমাধানের উপায়ই-বা কি- এ নিয়ে চিন্তিত দেশের বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাধারণ শিক্ষার্থীরাও। গত কয়েক বছরের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০১৩ সালে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ক্লাস হয়নি ২১৮ দিন (সূত্র: প্রথম আলো)। ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান ২১৮ দিনকেও ছাড়িয়ে যাবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় যদি মাসকে মাস ছাত্ররাজনীতির ভয়াল থাবায় এভাবে বন্ধ থাকে তাহলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের পরিণতি কী হবে?

গত তিন-চার বছর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়টি সেশনজটমুক্ত ছিল। তৎকালীন উপাচার্যের দূরদর্শিতায় ক্যাম্পাস অনেকটাই শান্তিপূর্ণ ছিল, ফিরে এসেছিল শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। কিন্তু বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদকালে বারবার বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। ফলে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ স্যার কতটা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার যোগ্য?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রয়েছে অসংখ্য গ্রুপ এবং উপগ্রুপ। তাদের একটি অংশ মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং অপর অংশটি মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী। সম্প্রতি চবি ছাত্রলীগের মধ্যকার কোন্দল নিরসনে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ, এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, আ জ ম নাছির উদ্দিন, বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ ও চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার হাফিজ আক্তার পৃথক পৃথকভাবে গত ২৫, ২৬, ২৯ ও ৩০ অক্টোবর চার দফায় বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে নেতাদের পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করার জন্যে নির্দেশ দেওয়া হয়। বার বার বৈঠক করে অনুজদের সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়ার পরও তারা তা মানছেন না। উল্টো বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিষয়টিকে সমালোচনার চোখে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

সাধারণ শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাবিদরা মনে করেন, ছাত্ররাজনীতি থেকে মুক্তি পেতে হলে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন দরকার। এছাড়া শান্ত ও সুন্দর শিক্ষাঙ্গন আশা করা যায় না। শিক্ষার মূল লক্ষ্য অর্জন করতে হলে শিক্ষাঙ্গনের সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নতুন প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে পরিহার করতে হবে নেতিবাচক রাজনীতি। গত কয়েক যুগ ধরেই দেশের উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ পাদপীঠ কখনও শান্ত ছিল না। তার প্রধান ও একমাত্র কারণ হল রাজনীতি বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা। দেশের স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-শিক্ষকরা যেভাবে রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তাতে কখনও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নিরবচ্ছিন্ন শান্তি-শৃঙ্খলার সঙ্গে পরিচালিত হতে পারে না।

শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করার পেছনে যত কারণ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল শিক্ষকদের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। শিক্ষকতাকে একদা যথার্থই মহান পেশা হিসেবে জাতি অভিহিত করতো। কিন্তু এখন তা করতে কষ্ট হয়। কারণ তাদের একটি বিশাল অংশই লেখাপড়া, গবেষণার পরিবর্তে রাজনীতি করাই উত্তম কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ফলে মহান পেশার ক্ষেত্রটি এখন দূষিত, আর সেই দূষণই ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষাঙ্গনে।

স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের অধিকার রক্ষায় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচনের প্রচলন ছিল। কিন্তু বর্তমানে দলীয় রাজনীতির প্রভাবে বন্ধ হয়ে গেছে ছাত্রসংসদ নির্বাচন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ‘চাকসু’ নির্বাচন হয়। এরপর গত ২৪ বছর ধরে আর নির্বাচন হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমান অস্থিরতা নিরসনকল্পে ‘চাকসু’ নির্বাচন জরুরি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

গত কয়েক বছর যেভাবে চলছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে চলতে থাকলে চার বছরের অনার্স কোর্স সম্পন্ন করতে সাত-আট বছর লেগে গেলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। তাই এখনি সময়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শুরু করে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে আমূল পরির্বতন আনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল অস্থিরতা দূর করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় mamunurrashidmiajee@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।