১৮৮৩ সাল থেকে এ দেশের মুদ্রা, দুর্লভ আলোকচিত্র, পুস্তক, কোলাজ পদ্ধতির পোস্টার, পত্রিকার কাটিং, ভাষাশহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ইত্যাদির মতো ইতিহাসের উপাদান সংরক্ষিত রয়েছে এখানে। সেজন্য এই সংগ্রহশালাটিকে অনেকে ‘মিনি জাদুঘর’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।
সংগ্রহশালায় প্রবেশ করে সামনে তাকালেই দেখা যাবে ঐতিহাসিক আমতলার আমগাছের গুঁড়ি। যেখান থেকে ১৯৫২‘র ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি রয়েছে সংরক্ষিত এ সংগ্রহশালায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার দু’দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর রাজাকারদের সহায়তায় পাকহানাদারদের হাতে শহীদ হন তারা। দৃষ্টি আটকাবে বেশ কয়েকটি বড় আকারের কোলাজ ছবিতে। দুর্লভ এ সংগ্রহগুলোর মধ্যে রয়েছে ডাকসুর আজীবন সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্য ব্যক্তিবর্গের ছবি। এছাড়া রয়েছে ভাস্কর্য, ম্যুরাল প্রিন্ট, পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের ভিত্তিপ্রস্তরের ফলক, ১৯৪৮ সালের বাংলাভাষার প্রচারপত্র, ১৯৬৯ সালের বিভিন্ন দলিল, ৭০ সালের জলোচ্ছ্বাসের নানা দলিল, ৭১-এর ২৫ মার্চের ঘটনাবলির প্রামাণ্য নিদর্শনের সংগ্রহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনের দাওয়াতপত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্যাড, ৯০-এর অসংখ্য দলিল, জনতার উপর নিক্ষিপ্ত গুলির খোসাসহ নানা ঐতিহাসিক উপাদান।
সীমিত পরিসরের এ সংগ্রহশালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই ভিড় জমান বেশি। কথা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বিদ্যুতের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-র সামরিক আইন বিরোধী আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম, ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কথা বললেই সামনে চলে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা ডাকসু। সেসব ইতিহাসকে কাছ থেকে জানার ও দেখার তৃষ্ণা মেটায় এখানকার দুর্লভ সংগ্রহগুলো। ১৮৮৩ সাল থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের প্রায় হাজার খানেক বই ও ১৯৮২ থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শহীদদের নামের তালিকা আছে এ সংগ্রহশালায়। সর্বশেষ যোগ করা হয়েছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রথম দাবি উত্থাপনকারী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ছবি।
যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধাতব ও কাগজি মুদ্রা, অতীতের বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের আগমনের তথ্যচিত্র ও ইতিহাস।
রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের যশোর জেলাতে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামের আনন্দ-উদ্বেল ছবি। মুক্তিবাহিনীতে বাঙালির যোগদান ও পাক হানাদারের বিপক্ষে প্রাণপন যুদ্ধের ছবিও বাদ পড়েনি এ সংগ্রহে। আরো আছে শহীদজননী জাহানারা ইমামের স্মৃতিচিহ্ন ও সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে নিহত ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মঈন হোসেন রাজুর ব্যবহৃত জিনিসপত্র। আর এগুলো যেন ঐতিহ্য রক্ষারই এক অনন্য প্রয়াস। কক্ষের ভেতরে দেখা মিলবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতির। দেয়ালের সব জায়গায় রাখা আছে বিভিন্ন তথ্য সংবলিত আলোকচিত্র। রয়েছে ৩৫ জন ভাষাসৈনিকের মুদ্রিত সাক্ষাৎকার, ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক ২৯টি পোস্টার, ভাষাসৈনিকদের ১৫টি আলোকচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংবলিত ছবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্তের আলোকচিত্র, ভাষাসৈনিক আবুল কাসেম ও খালেক নওয়াজ খানের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, প্রচারপত্র, স্মারকলিপি ইত্যাদি। যা প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকে সকল দর্শনার্থীর জন্য। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারও খোলা থাকে এটি। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর’ নামে খ্যাত এই সংগ্রহশালাটির সবকিছুরই যেন কথা বলছে। যেন এরও রয়েছে ভাষা । বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের ঠিক উল্টো পাশে ডাকসু ভবনের দেয়ালে রোদের আলোতে ঝলমল করে ভাষাশহীদের ম্যুরালচিত্র।
স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হওয়া ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামের ফলক, যা দেখে মনের ভেতর জেগে ওঠে অন্যরকম চেতনা। দেশীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক এ সংগ্রহশালাটি মোলায়েম সুরে মানুষের কানে পৌঁছে দেয় গৌরবময় ঐতিহ্যের বার্তা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৭
এইচএমএস/জেএম