ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার রক্ত ঝরার মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। পতন ঘটেছিল সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের।
গণআন্দোলনে বিজয় এসেছিল বাঙালির। ফলে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহাকে।
সেই দ্রোহী জোহার শাহাদতের দিনটিকে দীর্ঘদিন ধরে ‘জাতীয় শিক্ষকদিবস’ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও রাবি প্রশাসন। কিন্তু ৫১ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এখন দিনটি শুধু রাবিতে পালিত হয় ‘জোহা দিবস’ হিসেবে। তাই এ দিনটিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জোহা চত্বরের পাশে রাজশাহী ইউনিভার্সিটি এডুকেশন ক্লাবের ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে এ দাবি জানান তারা। এই কর্মসূচিতে একাত্মতা ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।
তারা বলেন, ‘ড. জোহা কেবল রাজশাহী-ই নয় গোটা দেশের শিক্ষার্থীদের শিখিয়ে গেছেন কীভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়। তিনি শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তার আত্মত্যাগের কতটা মূল্য আমরা কতটুকু দিতে পেরেছি? তার এই আত্মত্যাগ এখনো জাতীয়ভাবে মূল্যায়িত হয়নি।
তারা আরও বলেন, বর্তমান সময়ের শিক্ষকদের সেই আদর্শ নেই যা ছিল জোহা স্যারের। বর্তমানে শিক্ষকেরা নিজেদের মধ্যেই বিভাজনে জড়িয়ে পড়েছেন। পদ-পদবীর জন্য তারা রাজনীতি করা নিয়ে ব্যস্ত। শিক্ষার্থীদের চেয়ে রাজনৈতিক সুবিধা এখন তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা দিনটিকে ‘জাতীয় শিক্ষকদিবস’ হিসেবে ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানান।
এদিকে বাংলাদেশে বছরে অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন করা হলেও এ দিবসটি জাতীয়ভাবে পালন করা হয়না আজও! অথচ দিনটিকে ‘শিক্ষকদিবস’ হিসেবে পালন করার সরকারি ঘোষণার জন্য দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তাও উপেক্ষিত।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, ৫১ বছরেও দিবসটিকে ‘জাতীয় শিক্ষকদিবস’ করা সম্ভব হয়নি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক। জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করা এখন সময়ের দাবি। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এ দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু আজও ঘোষণা আসেনি।
সেদিন যা ঘটেছিল: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি এবং সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে পাকিস্তানি সেনারা মিছিলে গুলি করতে উদ্যত হয়। খবর পেয়ে তৎকালীন রাবি প্রক্টর শামসুজ্জোহা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের সামনে দাঁড়ান।
এ সময় তিনি পাকিস্তানি সেনাদের গুলি করতে নিষেধ করে বলেন, কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে। একপর্যায়ে তিনি ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করে বেলা ১১টার দিকে ক্যাপ্টেন হাদী পিস্তল বের করে ড. জোহাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলিবিদ্ধ ড. জোহাকে পরে রাজশাহী মিউনিসিপল অফিসে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
ড. জোহার সংক্ষিপ্ত জীবনী: অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা ১৯৩৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বাঁকুড়া জেলা স্কুলে তিনি লেখাপড়া শুরু করেন এবং ১৯৪৮ সালে এই স্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন ড. শামসুজ্জোহা। ১৯৫০ সালের পর ড. জোহার পরিবার স্থায়ীভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৫৩ সালে ড. জোহা দ্বিতীয় শ্রেণীতে সম্মান ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি প্রথম শ্রেণীতে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স কারখানায় সহকারী কারখানা পরিচালক পদে শিক্ষানবিশ হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে বিস্ফোরকদ্রব্যের ওপর প্রশিক্ষণ লাভের জন্য তিনি ইংল্যান্ডে যান। সেখানে তিনি ইমপেরিয়াল কলেজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এআরসিএস ও বিএস স্পেসিয়াল ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন।
বিদেশ থেকে পিএইচডি ও ডিআইসি ডিগ্রি নিয়ে পুনরায় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। ড. জোহা শহীদের সময় স্ত্রী নিলুফা জোহা ও এক কন্যা সন্তান রেখে যান। দীর্ঘদিন থেকে তারা আমেররিকায় বাস করেন। বর্তমানে তারা সেখানকার নাগরিক।
জোহার স্মৃতি রক্ষার্থে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন স্থাপনা: ড. জোহার স্মৃতি রক্ষার্থে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চার টাকা মূল্যের ডাক টিকিট চালু করা হয়। রাবি ক্যাম্পাসে একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয় তার নামে। শহীদ শামসুজ্জোহা হলের সামনে রয়েছে স্মৃতি ভাস্কর্য স্ফূলিঙ্গ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রশাসনিক ভবনের সামনে চোখে পড়বে জোহার সমাধি ও জোহা স্মৃতিফলক।
শাহাদত বার্ষিকীর আয়োজন: ড. জোহার শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে এদিন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে প্রশাসন। এর মধ্যে আছে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কালো পতাকা উত্তোলন, সকাল পৌনে ৭টায় ড. জোহার মাজার ও স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ। এরপর বিভিন্ন বিভাগ, আবাসিক হল, স্কুল, পেশাজীবী সমিতি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে শহীদ ড. জোহার সমাধি ও জোহা স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
সকাল সাড়ে ৮টায় রাবি অফিসার সমিতি কার্যালয়ে আলোচনা সভা হবে। সকাল ১০টায় শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সিনেট ভবনে জোহা স্মারক বক্তৃতা।
এতে বক্তব্য রাখবেন রাবির সাবেক উপ-উপাচার্য ও সাবেক উপাচার্য এবং যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার প্রফেসর এম সাইদুর রহমান খান। বাদ জোহর রাবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কোরআনখানি ও বিশেষ মোনাজাত।
বিকেল ৪টায় শহীদ শামসুজ্জোহা হলে দোয়া মাহফিল ও সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শহীদ শামসুজ্জোহা হলে প্রদীপ প্রজ্জ্বালন ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। এছাড়া শহীদ শামসুজ্জোহা স্মরণে শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হবে রচনা প্রতিযোগিতা।
এই দিন শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত রাখা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০
এসএস/এএটি