বরিশাল: ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যকার তিনটি নির্বাচন বাদ দিয়ে হিসাব কষলে বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনটি বিএনপির আসন হিসেবেই দেখা যায়। কারণ ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত এ আসনে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন চারবার আর জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন দুইবার করে।
তবে এবারে এ আসনটি বেশি আলোচনায় রয়েছে বিএনপির দুই হেভিওয়েট কেন্দ্রীয় নেতার পাশাপাশি আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদের কারণে। এছাড়া এ আসনে অধ্যক্ষ জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবরকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য।
অধ্যক্ষ জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার বিষয়ে আমি আশাবাদী। আর জয়ী হলে অবশ্যই জনগণের লাভের কথা ভেবে বাবুগঞ্জ-মুলাদীতে উন্নয়নও করা হবে।
তিনি বলেন, সরকার সংস্কারের চেষ্টা করছে, আবার ফ্যাসিবাদের বিচারের পর নির্বাচন হলে ফ্রি-ফেয়ার ভোট হওয়ার প্রত্যাশা করি। তাতে দিনের ভোট রাতে কিংবা রাতের বেলা ভোট দেওয়ার মতো বিষয় থাকবে না বলে মনে করি। এত রক্তের বিনিময়ে নতুন করে যে বাংলাদেশ আমরা পেলাম, সেখানে জনগণের স্বার্থে রিফর্ম প্রয়োজন।
এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ২০১৮ সালে এ আসনে যাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন এবারও তাকে দিয়েছেন, তিনি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) উপাধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম।
এর বাইরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ ব্যতীত জাতীয় পার্টির নির্বাচনে আসার সুযোগ থাকলে তারাও প্রার্থী দিতে পারেন। এক্ষেত্রে ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত চারটি নির্বাচনের তিনবারের সাংসদ গোলাম কিবরিয়া টিপু আবারও প্রার্থী হতে পারেন। যদিও তিনি প্রার্থী হলে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন না দুই উপজেলার স্থানীয় বিএনপির নেতৃবৃন্দ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩ লাখের ওপরে ভোটার থাকা বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনে মনোনয়ন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বিএনপির দুই প্রভাবশালী নেতার মধ্যে। তারা দুজনেই বিএনপির ডাকসাইটে নেতা এবং এলাকায় জনপ্রিয়। একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, অপরজন কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন। তবে সেলিমা রহমানের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে কিছুটা সংশয় আছে নেতাকর্মীদের মাঝে। তারপরও এ দুজন বিএনপি নেতার মধ্যে সেলিমা রহমানের পেশা ব্যবসা আর জয়নুল আবেদিন পেশায় আইনজীবী। বিগত ১৭ বছরে তারা কয়েক ডজন মামলার আসামি হয়েছেন। সেলিমা রহমানকে বেশ কয়েকবার কারাভোগ করতে হয়েছে। তারপরও কেন্দ্রের পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলে বিএনপির রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছেন এই দুই নেতা। যদিও এ দুজনের বাইরে মুলাদী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবদুস সাত্তার খান দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
বাবুগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা তরুণ ভোটার সাইফুল ইসলাম বলেন, এবারের ভোট যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, তাহলে ভোটাররা কেন্দ্রে যাবে এমনটা আশা করা যাচ্ছে। আর প্রার্থী বেশি হলে সেক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাও বেশি থাকবে। তবে বিএনপির কে প্রার্থী হবেন সেটা এখন ভোটারদেরও প্রশ্ন। বিএনপির মোশাররফ হোসেন মংগু ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত টানা চারবার এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর পরের নির্বাচনগুলোতে যেই সংসদ সদস্য হোক না কেন, তার জনপ্রিয়তার কাছে কেউ যেতে পারেননি। তাই এবারের নির্বাচন এ আসনে বিএনপির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ও সম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তো তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণাই দিয়েছে। সেইসাথে এবি পার্টি প্রার্থীও সংসদীয় এলাকায় প্রতিনিয়ত চষে বেড়াচ্ছেন, মানুষের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। এর বাইরে জাতীয় পার্টি কিংবা কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী জোটের ওয়ার্কার্স পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলে এ আসনে প্রার্থী দিতে পারে। তবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলাম এ অঞ্চলে তাদের দলের বিস্তৃতি বাড়িয়েছে, তাই কোনো প্রার্থীকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আবার তরুণ ভোটাররাও এ আসনে প্রার্থীর জয়ের জন্য বড় একটি ফ্যাক্ট হয়ে দাঁড়াবে।
মুলাদী উপজেলার বাসিন্দা ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাউদ্দিন হিমেল বলেন, বিএনপি গত ১৭ বছর আন্দোলন সংগ্রাম করলেও জনগণ থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি, বিপদে-আপদে বিএনপির নেতাকর্মীরা জনগণের পাশেই ছিল। শহীদ জিয়াউর রহমানের পরিবারের তথা বিএনপির বিশ্বস্ত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিনর ওপর ২০১৮ সালের মতো এই নির্বাচনেও ভরসা রাখবে বিএনপি। তিনি সাদা মনের মানুষ। বাবুগঞ্জ মুলাদীর মানুষের সুখে দুঃখে সব সময় পাশে ছিলেন এবং থাকবেন। আর এক্ষেত্রে এই আসনে বিএনপির জয়ী হতে বেগ পেতে হবে না।
তবে নদী বেষ্টিত এ সংসদীয় এলাকায় যিনিই প্রার্থী হোন না কেন, তাকে ভোটের জন্য জনগণের দ্বারে দ্বারে যেতে হবে বলে মনে করেন সাধারণ ভোটাররা। আর এ কাজে যে যত বেশি এগিয়ে থাকবে এবং জনগণের মন জয় করতে পারবে সে ততো বেশি ভোট পাবে।
আর নির্বাচন নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বরিশাল মহানগরের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, যদি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে সংস্কার করে নির্বাচন হয়, তাহলে বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য পরে করতে হবে। আর যদি পূর্বের নিয়মে কিছু সংশোধন এনে নির্বাচন করা হয় তাহলে মানুষ সাবধান হবে এবং বিগত দিনের সমস্যা ও সংকট থাকবে না বলে মনে হচ্ছে।
উল্লেখ্য, বারবার সীমানার পরিবর্তন ঘটলেও বরিশাল-৩ আসনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখান থেকে ১৯৭৩ সালে মোতাহার উদ্দিন (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ), ১৯৭৯ সালে এম. এম. নজরুল ইসলাম (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ), ১৯৮৬ সালে মো. আব্দুল বারেক (জাতীয় পার্টি), ১৯৯১ সালে মোশাররফ হোসেন মংগু (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল), ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ তে মোশাররফ হোসেন মংগু (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল), জুন ১৯৯৬ তে মোশাররফ হোসেন মংগু (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল), ২০০১ সালে মোশাররফ হোসেন মংগু (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল), ২০০৮ সালে গোলাম কিবরিয়া টিপু (জাতীয় পার্টি), ২০১৪ সালে টিপু সুলতান (বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি), ২০১৮ সালে গোলাম কিবরিয়া টিপু (জাতীয় পার্টি), ২০২৪ সালে গোলাম কিবরিয়া টিপু (জাতীয় পার্টি) নির্বাচিত হয়েছেন।
এমএস/এজে