ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

নাটকীয়তা শেষে উৎসবেই রূপ নিলো রাসিকের ভোট

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১০ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৮
নাটকীয়তা শেষে উৎসবেই রূপ নিলো রাসিকের ভোট লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন ভোটাররা, ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: নানান নাটকীয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশেই রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপক্ষো করে ১৩৮টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। মাঝে দুপুরে বৃষ্টি হানা দিলেও ভোটের স্রোত থামেনি।

 

ভোট শুরুর আগে থেকেই কেন্দ্রের সামনে জড়ো হতে থাকেন নানা বয়সী মানুষ। লম্বা লাইন দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দেন তারা।

এ সময় উপস্থিতি কিছুটা কম থাকলেও দুপুর গড়াতেই কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের ঢল নামে।

এছাড়া নগরীর প্রতিটি কেন্দ্রেই নারী ভোটারের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন ভোটারেরা। দিনের শুরুতেই সকাল সাড়ে ৮টায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী এইচএম খায়রুজ্জামান লিটন নগরীর স্যাটেলাইট টাউন হাইস্কুল কেন্দ্রে ভোট দেন।

পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এখন পর্যন্ত নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন। আমরা এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশই চেয়েছিলাম। আশাকরি শেষ পর্যন্ত এমন পরিবেশই থাকবে।

জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী লিটন বলেন, জয় আসবেই। এরপরও বলছি নির্বাচনে জয়-পরাজয় যায়ই হোক না কেন সেটা মেনে নেব। এটা আমি আগেও বলেছি। এখনও বলছি। কারণ নির্বাচনে যাই হোক ফলাফল মেনে নেওয়ার মানসিকতা সবাইকে রাখতে হবে।

এদিকে, আগের দিন (২৯ জুলাই) এক ক্ষুদে বার্তায় বুলবুল সকাল ৮টায় একই কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার কথা জানালেও শেষ সময় পর্যন্ত তিনি নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেননি। এ নিয়ে নগরীতে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

তবে এসব প্রশ্নের উত্তরে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘যে দেশে গণতন্ত্র নেই সেখানে আমার ভোট দিয়ে কোনো লাভ নেই। কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলাও করতে আমি রাজি নই। ’

সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বুলবুল বলেন, ‘পুরো নগরীতে একই অবস্থা। সব কেন্দ্র দখল করে আছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আমি কোনো কেন্দ্রে যাব আর কোনো কেন্দ্রে গিয়ে ঠেকাবো। তাই কেন্দ্রের বাইরে বসে আছি। ’

তার অভিযোগ ওই কেন্দ্রে মেয়রপ্রার্থীর ব্যালট শেষ হয়ে গেছে। মোসাদ্দেক হোসেন প্রিজাইডিং কর্মকর্তার কাছে ব্যালটের হিসাব চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ব্যালটের হিসাব না পেলে তিনি সেখান থেকে যাবেন না।

এদিকে, সোমবার সকালে নগরীর ২২ ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের সরব অবস্থান থাকলেও সকাল থেকেই মাঠে অনুপস্থিত বিএনপির নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের সহায়তায় বিএনপি প্রার্থীর কোনো তালিকা সরবরাহ বা বুথও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

নগরীর ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের শাহ্ মখদুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সকাল থেকেই উপচে পড়া ভিড় চোখে পড়ে। কেন্দ্রে ভোট দিতে লাইনে দাঁড়ানো জনাব আলী বলেন, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন চলছে। আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট সহায়তা করছে।

ভোট দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক বয়োবৃদ্ধ স্বপ্না রাণী দাশ বলেন, জাতীয় নির্বাচনসহ এ নিয়ে ছয়বার ভোটাধিকার প্রয়োগ করছি। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। ভোট কেন্দ্রে খুবই শান্ত পরিবেশ। নিজের ভোটাধিকার নিজে প্রয়োগ করবো এটা ভেবে ভাল লাগছে।

ওদিকে সকাল ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে নির্বাচনকে ঘিরে মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়। নগরীর সাহেরা খাতুন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সকাল থেকেই ছিল নারীদের উপচেপড়া ভিড়। অপেক্ষমাণ ভোটারদের লম্বা লাইন স্কুল প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে সড়কের ওপরেও চলে আসে। বেলা ১১টা পর্যন্ত তালাইমারী আদর্শ স্কুল ভোটকেন্দ্রে পুরুষ ভোট পড়েছে ২৬ শতাংশ এবং নারী ভোট পড়েছে ২৭ শতাংশ।

এখানকার নারী ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মনজুরুল হক বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে মানুষ ভোট দিয়েছে। এ কেন্দ্রের সবগুলো বুথে নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থীর এজেন্ট রয়েছে। ভোট নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই।

একই অবস্থা নগরীর বিনোদপুর এলাকার বিসিএসআইআর ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয় ও মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে। কেন্দ্রে নারী ভোটারদের লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।  

ভোট চলাকালে সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মৌলভি বুধপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে সজল নামের এক আওয়ামী লীগ সমর্থককে ছুরিকাঘাত করা হয়। সজল কাটাখালি পৌর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।  

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, জামায়াত-শিবিরের সমর্থকরা সজলকে ছুরিকাঘাত করেছে। ওই সময় ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী এইচএম খায়রুজ্জামান লিটন উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়। এছাড়া সকাল ১১টার দিকে নগরীর সরকারি সিটি কলেজের সামনে যুবলীগ কর্মী রকি ও রাকিবকে ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা।

বিকেল ৪টায় ভোটগ্রহণের সময় শেষ হলে নগরে আটকোশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে শতাধিক ভোটার জড়ো হন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার কেন্দ্রের সীমানায় ঢুকতে না পারায় তাদের ভোটদানের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় পরে তারা কেন্দ্রের বাইরে বিক্ষোভ করেন।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনে এবার প্রথমবারের মতো মেয়রপদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেয়র পদে পাঁচজন প্রার্থী হলেন- আওয়ামী লীগের এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন (নৌকা), বিএনপির মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল (ধানের শীষ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির হাবিবুর রহমান (কাঁঠাল), গণমঞ্চ ও গণসংহতি আন্দোলনের অ্যাডভোকেট মুরাদ মোর্শেদ (হাতি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শফিকুল ইসলাম (হাত পাখা)। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে মূলত নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থীর মধ্যেই হবে ভোটের লড়াই।

রাসিক নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার সৈয়দ আমিরুল ইসলাম জানান, সকাল থেকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। দুই-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। পেলেও তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

রাসিক নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার আতিয়ার রহমান জানান, নির্বাচনে মোট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ২১৭জন। এর মধ্যে মেয়রপদে প্রার্থী রয়েছেন পাঁচজন। আর ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আছেন ১৬০জন প্রার্থী। এছাড়া ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর পদের প্রার্থী ৫২জন।

এবার সিটি করপোরেশনের ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ১৮ হাজার ১৩৮ জন। মোট ভোটারের মধ্যে এক লাখ ৬২ হাজার ৫৩ জন নারী ও এক লাখ ৫৬ হাজার ৮৫ জন পুরুষ ভোটার। রাজশাহীতে এবার মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৮টি এবং বুথের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২০টি। এবার নগরীর দু’টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ করা হয়।

কেন্দ্র দুইটি রয়েছে রাজশাহীর বিবি হিন্দু একাডেমির নারী ও পুরুষ ভোটকেন্দ্র। এ বছর ১৩৮টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১১৪টিকেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মোতায়েন করা হয়ে ১৯ প্লাটুন বিজিবি ছাড়াও র‌্যাব সদস্যদের।

আতিয়ার রহমান বলেন, ৩০টি ওয়ার্ডে ৩০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করেছেন। আর সংরক্ষিত ১০টি ওয়ার্ডের জন্য ১০জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এছাড়া সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য পুলিশের একটি করে মোবাইল টিম কাজ করে। আর পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত দুইটি করে ওয়ার্ডের জন্য একটি করে স্ট্রাইকিং ফোর্স কাজ করে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৮
এসএস/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।