ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

বিভক্তি থাকলেও এগিয়ে এনামুল, ফিরতে চান আবু হেনা

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৮
বিভক্তি থাকলেও এগিয়ে এনামুল, ফিরতে চান আবু হেনা রাজশাহী-৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা

রাজশাহী: বৃহত্তম উপজেলা বাগমারা নিয়ে রাজশাহী-৪ আসন গঠিত। ৩৬৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ আসনে ইউনিয়ন ১৬টি, পৌরসভা দুটি। জাতীয় সংসদের ৫৬ নম্বর আসন এটি। এ নির্বাচনী এলাকার বর্তমান সদস্য আওয়ামী লীগের ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক।

বাংলাদেশের বহুল আলোচিত জনপদের একটি বাগমারা। স্বাধীনতার পর এখানে অভয়ারণ্য ছিল সর্বহারাদের।

তাদের দমনে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মাঠে নামানো হয় শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলাভাইকে। ওই সময় এখান থেকেই দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। তাদের নেতৃত্বে এখান থেকে জন্ম নেয় জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামের একটি জঙ্গি সংগঠন।

চরমপন্থি এবং ধর্মীয় জঙ্গিদের হাতে নিস্পেষিত বাগমারার মানুষ আপাত শান্তিতে বসবাস করলেও তাদের মনে অজানা আশঙ্কা তাড়া করে বেড়ায় সব সময়। তবে এক সময় উগ্রপন্থিদের নৃশংস কর্মকাণ্ডের জন্য পরিচিত রাজশাহীর বাগমারা অঞ্চলে এখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোটাই স্বাভাবিক।  

জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) বা সর্বহারা পার্টির তেমন তৎপরতা আর নেই। গত প্রায় ১০ বছরে বাগমারার রাস্তা-ঘাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। অবশ্য গত বছর স্থানীয় নির্বাচনের সময় সহিংসতায় চারজন নিহত হওয়ার ঘটনাটি আজও রাজনৈতিক অশান্তির আভাস হয়ে আছে। রাজনৈতিক কলহের কারণে মাঝে মাধ্যেই এখানে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।  

বিশেষ করে সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিভক্ত নেতাকর্মীদের কারণে দু-একটি জায়গায় উত্তেজনা ছড়ায়। আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুটি পক্ষের মধ্যে চাপা উত্তেজনা রয়েছে। এছাড়া দীর্ঘদিন সংসদের বাইরে থাকা বিএনপিতেও রয়েছে কোন্দল। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শিবিরে রয়েছে প্রার্থীর ছাড়াছড়ি।

১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বাগমারা-মোহনপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসন থেকে বিএনপির আবু হেনা সংসদ সদস্য হন। ২০০৪ সালে বাগমারায় জেএমবির উত্থানের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, দলের ও জামায়াতের কয়েকজন নেতার নাম জড়িয়ে বক্তব্য দেওয়ায় তিনি দলের বিরাগভাজন হন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সংস্কারপন্থি বলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।  

২০০৮ সালের নির্বাচনে রাজশাহী-৪ আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে আসে। সেবারের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পান দলের তৎকালীন বাগমারা উপজেলা শাখার সভাপতি আবদুল গফুর। তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী এনামুল হকের কাছে প্রায় ২৫ হাজার ভোটে পরাজিত হন। এর পর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনাভোটে আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক।

এর আগে মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদে এই আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা সরদার আমজাদ হোসেন। এ সময় তাকে ঘিরে গড়ে উঠে শক্ত একটি রাজনৈতিক বলয়। ফলে দল ত্যাগ করে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) যোগ দিয়েও সরদার আমজাদ হোসেন একাধিকবার এখান থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর মধ্যে জাপার প্রার্থী হিসেবে তিনি তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার মৃত্যুর সাথে জাতীয় পার্টিরও মৃত্যু হয় এখানে। মাঝখানে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে পাশের নওগাঁ জেলার আত্রাই থানার বিএনপি নেতা এ কে এস কে এম আফজাল হোসেন দলীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এই আসনে।

১৯৯৬ সালের বহুল আলোচিত ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে এখানে সংসদ সদস্য হন বিএনপি নেতা অধ্যাপক আব্দুল গফুর। পরবর্তীতে সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনে সাবেক সচিব আবু হেনা বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মূলত তার সময়েই বাগমারায় শক্ত অবস্থান করে নেয় বিএনপি। জোট সরকারের আমলে বাংলাভাইয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে কেন্দ্রীয় বিএনপিতে কোনঠাসা হয়ে পড়েন আবু হেনা। জেএমবির মদতদাতা হিসেবে বিএনপির একাধিক নেতার নাম ফাঁস করে দিলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ফলে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হন তিনি। মনোনয়ন দেয়া হয় জেলা বিএনপির সহসভাপতি অধ্যাপক আব্দুল গফুরকে।  

বর্তমানে রাজশাহীর বাগমারা আসনটিকে সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভক্তি ছড়িয়ে পড়েছে। এখান থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে খোদ আওয়ামী লীগই। দলের বেশ কয়েকজন নেতা এখান থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। এ নিয়ে বর্তমান এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের সঙ্গে তাদের শুরু হয়েছে তুমুল দ্বন্দ্ব। তবে এত বিভিক্তির মধ্যেও এগিয়ে রয়েছেন এনামুল।

দলীয় নেতাকর্মীদের দাবি, আগামী নির্বাচনেও এনামুল হক এই আসনে বলিষ্ঠ প্রার্থী। বিভিন্ন সময় তাকে ঘিরে নানা বিতর্কের জন্ম হলেও মাঠপর্যায়ে রয়েছে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা। বিশেষ করে এলাকার দরিদ্র মানুষকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে তিনি স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।  

বাগমারা উপজেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মতিউর রহমান টুকু বলেন, এনামুল তার জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন বছর বছর সালেহা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে বিনা খরচে চিকিৎসা, শিক্ষা সুবিধা দিয়ে, ঈদ-পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গরিবদের সহায়তা দিয়ে। তিনি এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের প্রতিবছর সংবর্ধনা দেন।  

এছাড়াও বিপদে-আপদে এলাকার সাধারণ মানুষের পাশে থাকেন এনামুল। তাই ভোটারদের কাছে তার জনপ্রিয়াতাই বেশি। দলের বড় একটি অংশের সমর্থন আছে তার প্রতি। এ কারণেই বিরোধীরা এখন অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বলেও দাবি করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের ওই সিনিয়র নেতা।

এদিকে, জনপ্রিয়তা থাকার পরও আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়াকে কেন্দ্র করে উপজেলা আওয়ামী লীগে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে দুটি পক্ষের মধ্যে। এক পক্ষের রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এনামুল হক। আরেক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলের উপজেলা শাখার বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক জাকিরুল ইসলাম সান্টু, তাহেরপুর পৌর মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ। নিজের এলাকায় মেয়র কালামের প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে।

রাজশাহী বাগমারা আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক বলেন, ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আসনটি থেকে আমাকে মনোনয়ন দেন। তিনি আমাকে বাগমারার মানুষের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আর বাগমারার মানুষও আমাকে গ্রহণ করেছিলেন, আমাকে বিজয়ী করেছিলেন। তার পর থেকে আমি সব সময়ই বাগমারার মানুষের পাশে আছি। এক সময়ের রক্তাক্ত জনপদে এখন শান্তির সুবাতাস বইছে। উপজেলার এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি।

সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তাহেরপুর পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ জানান, আমি আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করায় জেএমবির বাংলাভাই ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের লোকজন বারবার তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি থেমে থাকিনি। দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। রাজনীতিতে আমার ত্যাগ ও অবদান বিবেচনা করেই আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মনোনয়ন দেবেন বলে আমি আশাবাদী।

অপরদিকে জাকিরুল ইসলাম সান্টু বলেন, বাগমারায় আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে আমার অনেক অবদান রয়েছে। তাই আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত প্রাণ হিসেবেই আগামী নির্বাচনে আমি অংশ নিতে চাই। এর জন্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমি কাজ করে যাচ্ছি। তবে দলের প্রয়োজনে নৌকা প্রতীক যাকেই দেওয়া হোক না কেন, তার হয়েই আমরা কাজ করব।

একাদশ নির্বাচন কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে দলটির নেতারা প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লেও এক্ষেত্রে কিছুটা নিষ্ক্রিয় রয়েছে বিএনপি। বাগমারায় বর্তমানে বিএনপির জোরালো সাংগঠনিক তৎপরতা নেই। তবে দলে কোন্দল না থাকায় সুবিধাজনক অবস্থানে আছে দলটি।  

এ আসনের সাবেক এমপি আবু হেনাকে দলে ফিরিয়ে এনে মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষে তৃণমূল বিএনপির বেশিরভাগ কর্মী-সমর্থক। এছাড়াও মনোনয়ন চান জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল গফুর, জেলা বিএনপির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন তপু, উপজেলা বিএনপির সভাপতি ডিএম জিয়াউর রহমান জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জিয়া পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ডা. জাহিদ দেওয়ান শামীম এবং ড্যাব নেতা ডা. আশফাকুর রহমান শেলি।  

এদের মধ্যে সাবেক এমপি আবু হেনা বিএনপি থেকে বহিষ্কারের পর এলাকায় তেমন না এলেও দলের বহিষ্কৃত নেতাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগে উজ্জীবিত তার কর্মী সমর্থকরা। দলে সক্রিয় না থেকেও বর্তমান সরকারের আমলে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে, তার বেশিরভাগ আসামিদের উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ফলে বিএনপির একটি বড় অংশের মতে, বাগমারায় আবু হেনার বিকল্প নেই।  

অন্যদিকে রাজশাহী জেলা বিএনপির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন তপু রাজশাহী মহানগরীর অধিবাসী। বাগমারায় সেভাবে যান না তিনি। দলের কোনো কর্মসূচিতে না থাকায় অধ্যাপক আব্দুল গফুর বর্তমান সরকারে আমলেও রয়েছেন নিশ্চিন্তে। আমেরিকা প্রবাসী ডা. জাহিদ দেওয়ান শামীমেরও এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ কম। তবে এলাকায় সক্রিয় রয়েছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ডিএম জিয়াউর রহমান। তিনি প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।  

বাগমারা আসনে মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১০৬টি। এই আসনের মোট ভোটার ২ লাখ ৭৭ হাজার ৯৮৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৭৪ জন এবং নারী ১ লাখ ৩৯ হাজার ২১৪ জন।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৮
এসএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।