না ফেরার দেশে চলে গেলেন চাষী নজরুল ইসলাম। জীবদ্দশায় চলচ্চিত্রে শিল্পে তিনি রেখে গেছেন অনবদ্য সব কাজের স্বাক্ষর।
বন্ধুকে হারালাম
রাজ্জাক
আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। ষাটের দশকে ওর আর আমার ক্যারিয়ার একসঙ্গে শুরু হয়েছিলো বলা যায়। ‘ওরা ১১ জন’, ‘শুভদা’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘বাজিমাত’ ছবিগুলোতে তার পরিচালনায় অভিনয় করেছি। অসুস্থ হওয়ার পর চাষী মাঝে বিদেশে গিয়েছিল, তখন আমিও অসুস্থ। ও দেশে ফেরার পর ফোনে কথা হয়েছিলো। ওকে বলেছিলাম, শরীরটা আমারও ভালো না। দোয়া করিস আমার জন্য। এ ছাড়া প্রায়ই আমার ছেলে সম্রাটকে দিয়ে তার শরীরের খোঁজখবর নিতাম। কারণ তখন ল্যাবএইডে খুব অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলো চাষী। ওর চলে যাওয়ায় খুব খারাপ লাগছে আমার। বন্ধুকে হারিয়ে মনটা বিষন্ন হয়ে আছে। তারপরও আগামীকাল (১২ জানুয়ারি) এফডিসিতে তার জানাজায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
ঘুমিয়ে থাকায় কথা হয়নি
ইলিয়াস কাঞ্চন
‘ভালোবাসা’ নামে একটি ছবিতে কাজের মাধ্যমে চাষী ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। এর প্রযোজক ছিলেন প্রয়াত অভিনেতা বুলবুল আহমেদ। এতে অভিনয় করেছিলেন ববিতা আপাও। সেই থেকে চাষী ভাইয়ের সঙ্গে আমার ভালো সখ্য ছিলো। এর বাইরে তার ‘শাস্তি’ ছবিতে কাজ করেছি। এতে অভিনয়ের আমাকে পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু আমি পুরস্কারটি প্রত্যাখান করি। তার সহকারী পরিচালক ভুল করে আমার নাম পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন জুরি বোর্ডের কাছে। সে যাই হোক, গোপীবাগে চাষী ভাইয়ের বাসায় প্রায়ই যেতাম। চাষী ভাইকে সবাই পছন্দ করতেন। যা বলার সামনাসামনি বলে দিতেন তিনি। সর্বশষ চাষী ভাই ও আমি ‘বাংলার ফাটাকেষ্টো’ ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছি। যদিও এটি নানা কারণে সেন্সরে আটকে আছে। সবশেষ ১০-১২ দিন আগে তার অসুস্থতার খবর পেয়ে কমলাপুরের বাসায় গিয়েছিলাম। তখন তিনি ঘুমিয়ে থাকায় কথা হয়নি। তবে তার নাজুক অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগছিলো। এফডিসিতে আগামীকাল (১২ জানুয়ারি) জানাজায় যেতে চাই। তার জন্য আমার শ্রদ্ধা রইলো।
এটি একটি ইতিহাস
ববিতা
মৃত্যুর সংবাদ সবার জন্যই বেদনাদায়ক। কিন্তু আমাদের কাছের মানুষগুলো এভাবে হঠাৎ চলে যাচ্ছেন, এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। চাষী ভাই আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। কয়েকদিন আগেও তার বাসায় গিয়েছিলাম। তার অসুস্থতা দেখে খুব খারাপ লাগছিলো। তার সঙ্গে অভিনয় বা কাজ হয়েছে বলে নয়, তার মতো পরিচালক সত্যি দুষ্কর। কারণ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি। ‘ওরা ১১ জন’ যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ছবি, তেমনি এটি একটি ইতিহাস। তিনি অনেক সাহসী পরিচালক ছিলেন। ‘ভালোবাসা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘ভালো মানুষ’, ‘মিঞা ভাই’, ‘হাসন রাজা’সহ তার পরিচালনায় বেশকিছু ছবিতে ও আমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে বেশকিছু ছবিতে চাষী ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করেছি। তার জন্য মন কাঁদছে। আগামীকাল (১২ জানুয়ারি) এফডিসিতে তার জানাজায় যাবো।
হাতে-কলমে শিখিয়েছিলেন
চম্পা
খবরটা শুনেই সকাল থেকে খারাপ লাগছে। চাষী ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে আমার অনেকদিনের সম্পর্ক। চাষী ভাই আমার শ্বশুরবাড়ির দিক দিয়ে (বিক্রমপুরে) আত্মীয় বলা যায়। যতদূর জানি তিনি সম্পর্কে আমার ভাসুর ছিলেন। আমাকে অনেক স্নেহ করতেন ছোটবেলা থেকে। তিনি খুব স্নেহশীল মানুষ। তার মনটা ছিলো শিশুসুলভ। সবকিছুই ইতিবাচকভাবে দেখতেন। তাকে কখনও পরনিন্দা বা পরচর্চা করতে দেখিনি। চাষী ভাইকে হাসপাতালে দেখতে বেশ কয়েকবার গিয়েছি। তার দুই মেয়ে আন্নি ও মান্নির সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। ভাবীও অনেক স্নেহ করতেন আমাকে। তাদের বাসায় কতো যে খেয়েছি তার হিসাব নেই! বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য নিয়ে চাষী ভাইয়ের পরিচালনায় ‘বিষবৃক্ষ’ ছবিতে কাজ করেছি প্রথম। এতে ববিতা আপা আর রাজ্জাক ভাই ছিলেন আমার সহশিল্পী। ছবিটির কুন্দনন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। তখন আমার বয়সও কম ছিল। তার সঙ্গে কাজ করে অস্বস্তি বা ভয় লাগেনি। চাষী ভাই প্রতিটি দৃশ্য হাতে-কলমে শিখিয়েছিলেন। এরপর চাষী ভাইয়ের পরিচালনায় ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ ছবিতে কাজ করেছি। এ ধরনের সুন্দর গল্প ও শ্রুতিমধুর গানের ছবি এখন খুব কমই হয়। তার ‘শাস্তি’তে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি আমি। এই মানুষটির সঙ্গে কাজ করে অনেক কিছু শিখেছি।
‘স্যার’ বলে ডাকতাম
শাকিব খান
আমি তাকে ‘স্যার’ বলে ডাকতাম। আমার প্রথম প্রযোজিত ছবি ‘হিরো দ্য সুপারস্টার’-এর মহরতের সময় তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। আমার অভিভাবকের মতো ছিলেন তিনি। মাঝে একবার তিনি থাইল্যান্ড গিয়েছিলেন। তখন আমার একটা ছবির কাজ চলছিলো বামুন্ডায়। কাজ শেষে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে তিনি চলে গিয়েছিলেন। তবে আমার এক বন্ধু তাদের ছবি তুলেছিলেন। কালো শার্ট, সাদা প্যান্ট পরে মার্জিত চেহারায় তাকে প্রাণবন্ত লাগছিলো। তখন পর্যন্ত দেখলাম বেশ ভালো আছেন তিনি। মানুষটা সবসময় পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। তার পরিচালনায় ‘দেবদাস’ ও ‘সুভা’ ছবিতে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। তিনি ছিলেন অন্যরকম এক ব্যক্তিত্ব। আর আমার জীবনের অনেক ভালো-মন্দ ভাগাভাগি করতাম তার সঙ্গে। অনেক সহযোগিতা আর অনুপ্রেরণা পেয়েছি তার কাছে। আমি একজন অভিভাবককে হারালাম।
‘একটা সিগারেট দে’
রিয়াজ
একটি ছবির শুটিংয়ে গিয়ে চাষী ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। এরপর তার পরিচালনায় ‘মেঘের পরে মেঘ’ ও ‘শাস্তি’ ছবিতে অভিনয় করেছি। বেশ ভালো একজন মানুষ ছিলেন তিনি। বছর দেড়েক আগে একটি বিজ্ঞাপনের সেটে তার সঙ্গে আমার সামনাসামনি কথা হয়। তার সিগারেট খাওয়া নিষেধ ছিলো। কিন্তু আমার সঙ্গে অনেক প্রাণখোলা ছিলেন তিনি। সেদিন বলেছিলেন ‘একটা সিগারেট দে। ’ সবসময় আনন্দের মধ্যে থাকতে পছন্দ করতেন চাষী ভাই। অনেক কিছু মনে পড়ছে আজ। চলচ্চিত্রশিল্প শুধু বড় মাপের একজন পরিচালককেই নয়, ভালো একজন মানুষকেও হারালো।
বাংলাদেশ সময় : ১৪৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৫