অনেক দিন বন্ধ রেখে নব্বই দশকে আবার হলে ছুটেছিলাম। হুমায়ূন আহমেদের টানে।
আরও মনে পড়ে ২০০১ সালের দিকে এক নিঝুম অপরাহ্নে ঢাকার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে ‘উত্থানপর্ব’ অফিসে আহমদ ছফা ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছি। অকস্মাৎ সেখানে পশ্চিমবঙ্গের কবি জয় গোস্বামীর আগমন; সঙ্গে ছত্রধারী হিসাবে আমাদের প্রয়াত বন্ধু কবি ত্রিদিব দস্তিদার। জয়কে রোদ থেকে বাঁচাতে ত্রিদিব আক্ষরিক অর্থেই ছাতা নিয়ে ঘুরছিলেন। জয় গোস্বামী আমাদের সঙ্গে বইয়ের দোকানগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে বাংলাদেশের তিনজন লেখকের বই যা পাচ্ছিলেন, সবগুলোই কিনে নিচ্ছিলেন। জয়ের সংগ্রহ তালিকাভূক্ত বাংলাদেশের এই তিনজন লেখক ছিলেন- আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার এবং হুমায়ূন আহমেদ। লেখক সত্ত্বা ধরে রেখেও টিভি বা চলচ্চিত্রে কেমন করে এতোটা বাহাদুরি হুমায়ূন দেখাতে পারছেন, সেটাও ছিল সেদিনের আলোচ্য বিষয়।
এ তথ্যের সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানানো দরকার যে, অতি রক্ষণশীল ও গোঁড়া আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর ‘দেশ’ ম্যাগাজিন তাদের ঢাউস সাইজের পূজা সংখ্যার জন্যে হুমায়ূন আহমেদের লেখা প্রার্থনা করতো- কখনও পেত, কখনও পেত না। বাংলাদেশের অন্য কোনও লেখকের লেখার জন্যে তাদের বিচলিত হতে দেখা যায় নি। অথচ হুমায়ূন আহমেদ কখনও কলকাতা নিয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে তার কোনও লেখা বা বক্তব্য থেকে জানা যায় না। যদিও বাংলাদেশের অনেক কবি বা গল্পকার মনে করেন, বাইরের কল্কে পেলে তারা ‘অমর’ হয়ে যাবেন। হুমায়ূন আহমেদ মানুষকে বিশ্বাস করতেন; পাঠককে সম্মান করতেন; কোনও পৃষ্ঠপোষক-মোড়লকে গ্রাহ্য করতেন না। বাংলাদেশের হৃদয় থেকে লিখতেন। মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি অবস্থান করতেন। বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষী মানুষের হৃদস্পন্দনের সঙ্গে ছিল তার সংযোগ। মানব মনস্তত্ত্বের অদেখা ভুবনের উন্মোচনে তিনি ছিলেন এক বিস্ময়কর ও কুশলী কারিগর। আশা ও আশাভঙ্গের মেরুকরণে ব্যক্তিক আর্তি আনন্দ-বেদনায় প্রাণ পেয়েছে তার অলৌকিক কলমে। সেলুলয়েডে এবং ছোট পর্দায় অমলিন হয়ে আছেন তিনি।
স্বাধীনতার আগে বড় বোনের কোলে চড়ে ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি দেখে যে চোখ বিস্মিত হয়েছিল। সে চোখ ডি সিক্কা, কুরোসাওয়া, সত্যজিৎ, চ্যাপলিন, রেনোয়া-এর কাজ দেখেছে। প্রথাগত ছবির সঙ্গে সঙ্গে টেকনিক্যাল চমকে হারিয়ে গেছে হলিউডের আধুনিক ফ্যান্টাসিতে। তারপরও চোখ খুঁজে চলচ্চিত্রের ভেতরের দর্শন। সার্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’ বা ‘অক্টোবর’ দেখার পর আমরা তো চাইবো আমাদের সমাজের না দেখা বাস্তবতাটি ফুটে উঠুক। তেমন ছবি কই?
লেখক
ড. মাহফুজ পারভেজ
প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ২২৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৭
এইচএ/