ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূলে

বাতাসে ইলিশের ঘ্রাণ, তবুও অধরা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৭, ২০১৩
বাতাসে ইলিশের ঘ্রাণ, তবুও অধরা

উপকূল ঘুরে (ভোলা): ঘাটের বাতাসে তাজা ইলিশের ঘ্রাণ। মেঘনা নদীর অথৈ পানিতে দাপিয়ে বেড়ানো ইলিশের দল উঠে এসেছে ঘাটে।

আড়তে হাঁকা হচ্ছে দর। দরদাম ঠিক হওয়ার পর ট্রাকে কিংবা লঞ্চে শহরের পথে ছুটে মেঘনার তরতাজা ইলিশ।

এসব কাজে জেলে আর আড়তদারদের ব্যস্ততার কোনো শেষ নেই। এ মুহূর্তে জেলেরা সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ভোর থেকে ভোররাত অবধি একই কাজ করে চলেছেন।

ইলিশ ধরার অন্যতম প্রধান এলাকা ভোলার মেঘনার তীর লাগোয়া ঘাটগুলোতে এমন চিত্র নিত্যদিনের। ঢেউয়ে দুলতে দুলতে একের পর এক কিনারে ভিড়ছে ইলিশের ট্রলার। মাছ উঠে আসছে ট্রলার থেকে আড়তদারের বাক্সে। ঘাটে ইলিশের ট্রলার ভিড়লে কারো কথা বলার ফুরসৎ থাকে না। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবারের ইলিশ মৌসুমে ইলিশ ধরার পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। তাই সবার ব্যস্ততাও খানিকটা বেশি।

আশ্বিনের পড়ন্ত বিকেল। ভোলার ইলিশা চডার মাথাঘাটে ট্রাক বোঝাই হচ্ছে ইলিশ। বরফকল থেকে কিছুক্ষণ আগে আসা বরফ ইলিশের ঝুড়িতে দেওয়ার জন্য ক্রাশ (গুঁড়ো) করা হচ্ছে। কিছু আগে নদী থেকে ইলিশ এসেছে। তাই আড়তদারেরা অলস সময় কাটাচ্ছেন।

বিকেলে ইলিশ ধরে ফেরা কিছু ট্রলার ঘাটে বাঁধা। রাতে নদীতে যাওয়ার প্রস্তুতি। কেউ জাল মেরামত করছে, কেউবা রান্নায় ব্যস্ত। কেউবা অলস বিকেলটা ট্রলারের ছাদের ওপরই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন। যেন হাত পা বিস্তার করে আরও একটু শক্তি সঞ্চয় করে নেওয়া।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে। ঘাটের একপাশে সারি সারি কাঠের বাক্স। ট্রলারে আসা ইলিশ প্রথমে নামে এ বাক্সে। বাক্সের একপাশে আড়তে টেবিলের ওপর রেজিস্টার খাতা নিয়ে হিসাবে ব্যস্ত আড়তদারেরা।

এরাই জেলেদের মাছধরায় অর্থ বিনিয়োগ করে। এর নাম ‘দাদন’। মানে মাছ ধরতে আগাম টাকা দেওয়া। দাদন নিয়ে জেলেরা ট্রলারে মাছ ধরতে যায় নদীতে। ঘাটে ইলিশ আসার সঙ্গে সঙ্গেই দাম হাঁকা শুরু হয়। দাম ঠিক হলেই মাছ চলে যায় আড়তদারের কাছে।

ইলিশ ধরার এ ভরা মৌসুমে উপকূলের মেঘনা তীরবর্তী এলাগুলোর দৃশ্যপট একই রকম। দৌলতখানের ভবানীপুর, সৈয়দপুর, চৌকিঘাট, রামগতির আলেকজান্ডারের আসলপাড়া ছাড়াও রায়পুরের ইলিশঘাটগুলোতেও একই চিত্র। কোনো ধরনের বাধাবিঘ্ন ছাড়াই জেলেরা ইলিশ ধরায় ব্যস্ত। এ সময়ে বেশি মাছ ধরে জেলেরা ঋণের ভার কিছুটা কমাতে চান।

মৎস্য বিভাগ সূত্র বলছে, ইলিশের এ ভরা মৌসুমে জেলেদের সামনে আরেকটি সরকারি নিষেধাজ্ঞা আসছে। চলতি ১৩ থেকে ২৩ অক্টোবর অবধি মেঘনায় ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। কারণ এ সময়ে মা-ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য সমুদ্র থেকে নদীতে উঠে আসে।

মাছ ধরায় বছরের বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা এলেও এবার বেশি ইলিশ পড়ায় সেই সময়ের কষ্ট জেলেদের মনে নেই। জেলেরা ছাড়াও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকারের বিভিন্ন সময়ের পদক্ষেপেই এবার বেশি ইলিশ ধরা পড়ার অন্যতম কারণ।

ইলিশের ঘাটগুলো ঘুরেই বোঝা যায়, এবার জালে বেশি বেশি ইলিশ ধরা পড়ায় জেলেরা দারুণ খুশি। কথা বলতে বলতে সেই খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ে ৬০ বছর বয়সী জেলে শাহাজলের মুখে। মাত্র ১৬-১৭ বছর বয়স থেকে এখনও ইলিশ ধরছেন তিনি।

ইলিশাঘাটে ছোট্ট হোটেলে কথা বলার সময় আরও কজন জেলে সেখানে ভিড় জমায়। কেউ দুপুর ১২টার দিকে নদীতে গিয়ে বিকাল ৩টায় আবার কেউ রাত ৭টা থেকে ৮টার দিকে নদীতে গিয়ে ভোরে ঘাটে ফিরেছেন।

লক্ষীপুরের রামগতির আলেকজান্ডারের আসলপাড়া ঘাটের জেলেরা জানান, দাদনেই জেলেদের সর্বনাশ ঢেকে আনে। ইলিশ বেশি পড়ুক আর কম পড়ুক জেলেদের কিছুই যায় আসে না। জেলেরা আড়তদারদের কাছে বাঁধা পড়ে থাকে যুগের পর যুগ। দাদন নেওয়ার কারণে মাছের দাম পাওয়া যায় কম। তার ওপর বিক্রি হওয়া  মাছের মূল্য থেকে ৫ ভাগ কমিশন দিতে হয় আড়তদারদের।

লক্ষীপুরের রায়পুরের জেলেরা জানান, নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে নানা ঝড়-ঝাপটা বয়ে যায় জেলেদের ওপর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু সব ধরনের বাধা ও বিপদ মোকাবিলা করে মাছ ধরে ঘাটে ফেরেন তারা। নদী উত্তাল হলে জাল ফেলে আল্লাহর নাম জপ করেন। পরিবারের সবাইকে ফেলে ঝুঁকির মুখে থাকেন দীর্ঘ সময়। তারপরও ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন জেলেরা।

জেলেদের এ অভিযোগ অস্বীকার করে আড়তদার আবুল কাশেম হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, জেলেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই বিক্রি হওয়া মাছে ৫ ভাগ কমিশন রাখা হয়। তাদের মাছ ধরার সব নিশ্চয়তা দেয় আড়তদারেরা। মাছের ন্যায্যমূল্যই দেওয়া হয়।

স্থানীয় সূত্র বলছে, এ এলাকায় মাছধরার ইতিহাস ৭০-৮০ বছরের পুরোনো। কৃষিজমির পরিমাণ বেশি থাকার কারণে আগে মাছ ধরার লোক ছিল না। অধিকাংশই ছিল কৃষিকাজে ব্যস্ত। মেঘনার ভাঙনে জমি হারিয়ে সেই মানুষগুলোই এখন মাছ ধরে সংসার চালায়। আগে নদীতে গিয়ে নৌকা থেকে মাছ কেনা হতো। এ রীতি পর্যায়ক্রমে বদল হয়ে ঘাটভিত্তিক আড়তদারিতে পরিণত হয়েছে। মেঘনা তীরের ইলিশঘাটগুলোর ভাঙাগড়ার ইতিহাস অনেকটা এমনই। ভাঙনে ঘাটের চেহারা বদলাতেই থাকে।

ইলিশ ধরায় সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এবার ইলিশ আহরণের পরিমাণ বেশি। ইলিশার এ ঘাটগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি টাকার ইলিশ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।

ট্রাক ও লঞ্চে ইলিশ যায় ঢাকা, বরিশাল, নারায়ণুগঞ্জ, চাঁদপুর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে। জ্যেষ্ঠ থেকে আশ্বিন মাস অবধি ইলিশ বেশি পড়লেও ভাদ্র-আশ্বিন মাসে সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। এবার ভাদ্রে বেশ ভালো ইলিশ পড়েছে বলে জানালেন জেলেরা। কার্তিকের শুরু থেকে অনেক ইলিশ জালে ধরা পড়ছে।

কথায় আছে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। কিন্তু বাস্তবতা এখন পুরোপুরি উল্টো। এবার প্রচুর ইলিশ ধরা পড়লেও স্থানীয় লোকজনকে তাজা ইলিশের ঘ্রাণ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। বেশি দামের আশায় বড় ইলিশ পাঠানো হচ্ছে বাইরে।

একটু বড় আকারের ইলিশ বরফের চাদরে ঢেকে চলে যায় বড় শহরে। বিক্রি হয় আরও বেশি দামে। শহরের অবস্থাপন্নদের ঘরে রান্না হবে সুস্বাদু ইলিশ। আহরণ স্থান হোক কিংবা শহরেই হোক, সুস্বাদু ইলিশ বরাবরই সাধারণ ইলিশ ভক্তদের ধরা ছোয়ার বাইরেই থেকে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ০৪০৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৭, ২০১৩/আপডেট ১১৩৮ ঘণ্টা


আরআইএম/এসএইচ/জিসিপি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।