ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

সাড়া দাও নদীর গানে, নদীর ডাকে

ড.ফোরকান আলী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৩
সাড়া দাও নদীর গানে, নদীর ডাকে

নদীমাতৃক দেশ  বাংলাদেশ। কিন্তু যুগের নানা চাহিদা পূরণে দিন দিন রূপ বদলে যাচ্ছে দেশের নদীগুলোর।

তবে সেটি ভালো নয়, খারাপের দিকে। নদী বাঁচাতে চলছে নানা ধরনের চিন্তাভাবনা। এরপরও উন্নয়ন কাজের হার চাহিদার তুলনায় কম। বলা চলে আমরা খানিকটা নদীবিরোধীও।

যে নদী আবহমানকাল থেকে আমাদের লালন-পালন করে আসছে, সেগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা দূরে থাক- অনিষ্ট করতে পিছপা হই না আমরা। রাজধানী ঘেরা চারটি নদী- বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু দূষণ ও দখলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সারাদেশের নদীর চিত্রও খুব বেশি আলাদা নয়। নদীবিরোধী তৎপরতা এভাবে চলতে থাকলে নদীর ওপর নির্ভরশীল পুরো বাস্তুসংস্থান ও জলজজীবন জৈবিকভাবে একসময় মৃত হয়ে পড়বে।

এদেশে প্রতি বছর বন্যায় যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা এক কথায় প্রচুর। এ ব-দ্বীপের ভাগ্যে ক’হাজার বছর ধরে এমনটিই হয়ে আসছে। নদীর ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল অনেক দেশেই বর্তমানে বন্যার মতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তা এখানে অদৃশ্য। ক্ষয়ক্ষতি রোধে দেখা যায় না নদীগুলোর ব্যাপারে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বা উদ্যোগ। তবে সময় ফুরিয়ে যায়নি বলেই আমরা বিশ্বাস করি।

 যথাযথ উদ্যোগ নিলে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যাসহ অন্যান্য রুগ্ন নদীকে এখনও পুনর্জীবন দান করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সচেতনতা। নদীমাতৃক এদেশের পরিবহন ব্যবস্থা হতে পারত নদীপথনির্ভর। এদেশে প্রায় সব জেলার সঙ্গে নদীপথে যাতায়াত সম্ভব। উপভোগ্য নদী ভ্রমণের ব্যবস্থা করা গেলে পর্যটনের আকর্ষণও বেড়ে যাবে।

 বড় ব্রিজ তৈরিতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়, তার অর্ধেক টাকা দিয়েই সমগ্র বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত উন্নত নদীপথের পরিবহন কাঠামো তৈরি সম্ভব। তাতে হয়তো গতি কিছুটা কমে আসবে, কিন্তু বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে। এ ধারণা থেকেই হয়তো নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ঢাকার চারপাশে চক্রাকার জলপথ ও বুড়িগঙ্গায় ওয়াটার বাস চালু করেছে।

আমাদের নদীগুলোর নানা সমস্যার একটি বড় সমস্যা হল নদীর চর ও পাড় দখল। নদীর পাড় দখল হয়ে পড়লে দূষণ যেমন বেশি হয়, পাশাপাশি নদীর আদি গতিপথেরও পরিবর্তন ঘটে। সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করা তখন কঠিন হয়ে পড়ে। প্রশাসন মাঝে মাঝে নদী তীরবর্তী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সক্রিয় হলেও নিয়মিত তদারকির অভাবসহ নানা কারণে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। নদীগুলো কমবেশি এসব কারণেই এখন অরক্ষিত।

 নদী উন্নয়ন ও রক্ষণে এ দশার নানা নিয়ামক হিসেবে দক্ষ জনবলের ঘাটতি, প্রশাসনিক জটিলতা, উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার না করার পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা দরকার- নদীর প্রতি আমাদের উদাসীনতা। অবশ্য আমাদের মাত্রায় না হলেও এমন উদাসীনতা সারা বিশ্বেই রয়েছে। রয়েছে তা কাটিয়ে ওঠারও উদ্যোগ। রুগ্ন নদীগুলোর ভাগ্য পরিবর্তনের প্রত্যাশা নিয়ে ২০০৫ সাল থেকে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব নদী দিবস পালন করা হচ্ছে। ২০০৫ সালে করা হয়েছিল ৩০টি দেশে। বর্তমানে জাতিসংঘের অনেক সদস্য দেশেই দিবসটি উদযাপন শুরু হয়েছে।

 আশার কথা, বাংলাদেশেও নদী নিয়ে আগ্রহ ও সক্রিয়তা বেড়েছে। বাংলাদেশে এবারই প্রথমবার পালিত হয়েছে বিশ্ব নদী দিবস। বিশ্ব নদী দিবসে আন্তর্জাতিকভাবে সাধারণত একক প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে না। বাংলাদেশের জন্য বিশ্ব নদী দিবস ২০১০-এর প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিল- ‘নদী আমাদের ডাকছে, সাড়া দিতে হবে। ’

আমরা বিশ্বাস করি, নদী আমাদের ডাকছে; এখন সাড়া দিতে হবে। এ সাড়া আমরা নানাভাবে দিতে পারি।   যেমন বিশিষ্ট শিল্পী লেখক গায়ক তাদের মধুর কণ্ঠে নদীকে বিভিন্ন ভাবে তুলে ধরেছেন। নদীকে কেউবা ‘গাঙ’ বলেন। নদী অর্থাৎ গাঙকে নিয়ে অনেক গান লেখা হয়েছে।

যেমন- কণ্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দিন গেয়েছেন-‘আমার গহীন জলের নদী’; ‘একুল ভাঙে ওকুল গড়ে এইতো নদীর খেলা’; ‘ তোমার ভাইটাল সুরের সাথে সাথে কান্দে গাঙের পানি, আরে ও রঙিলা নায়ের মাঝি’; ‘নদীর কূল নাই কিনারা নাইরে আমি কোন কূল হইতে কোন কূলে যাব-’; ‘ওরে ধল্লা নদীর পারে যাইয়া দরশন দিলরে’; ‘এই তুফানেতে কেউ গাঙ পাড়ি দিও নাঃ ও আমার দরদী আগে জানলে’; ‘আমায় লয়ে যাওরে নদী সেই যে কন্যার দেশঃ কুচ বরণ কন্যারে তার মেঘ বরণ কেশ’; ‘ঐ যে ভরা নদীর বাঁকে কাশের বনের ফাঁকে ফাঁকে’; ‘কূল নাই কিনার নাই নাইক গাঙের পানি ঃ আমায় ভাসাইলিরে’। অখিল বন্ধু ঘোষ গেয়েছন -‘শিপ্রা নদীর তীরে’, শচীনদেব বর্মন গেয়েছেন-‘তুমি হও চান্দরে বন্ধু আমি গাঙের পানি’; ‘কে ঘাস ভাটির গাঙে নাও বাইয়া’; হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন-‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’; শ্যামল মিত্র গেয়েছেন-‘সাত সাগর আর তেরো নদীর পারে আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে’; সুপ্রীতি ঘোষ গেয়েছেন- ‘তটিনী নদীর মতো নেশা জাগায় দুই তীরে; আকাশে লক্ষ তারার দেয়ালি’ শ্যামল মিত্র গেয়েছেন-‘নদীতে ডুব দিয়ে সখি মুক্তো যদি পেতে চাও;।

ভূপেন হাজারিকা এক গানে গঙ্গা নদী ও পদ্মা নদীকে নিয়ে গেয়েছেন-‘গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা’। এ ছাড়া নদীকে নিয়ে যেমন-সুরমা নদী, কর্ণফুলী নদী, মেঘনা নদী, রূপসা নদী, কুশিয়ারা নদী, মধুমতি নদী, আড়িয়াল খাঁ নদী, তিস্তা নদী, যমুনা নদীকে নিয়েও শিল্পীরা বহু গান গেয়েছেন। শচীনদেব বর্মনই গেয়েছেন-‘পদ্মার ঢেউরে ও মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যারে। ফেরদৌসী রহমান গেয়েছেন-নদী তাই ঢেউয়ে টরমল ও রঙিলা। আবদুল আলীম গেয়েছেন-আমার গাঁয়ের নদীর ঘাটে -ও বন্ধুরে; আমি নদীর ঘাটেরে বন্ধু ভাটির গাঙ্গে ভাইটাল ঘুরে। যমুনা নদীকে নিয়ে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গেয়েছেন ঝাঁপ দিলি তুই মরণ যমুনায় - রাধে ভুল করে তুই; ও থর গহীন নদী উজান ধরে ভারী জল ভরা কাঞ্চন কন্যা।

তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় গেয়েছন- কাজল নদীর জলে ভরা ঢেউ ছলোছলে। গীতা দত্ত গেয়েছেন -নদীর বুকে ঢেউয়ের কল্লোল মাতন তুলেছে। সুপ্রীতি ঘোষ গেয়েছেন-তটিনী নদীর মতো নেশা জাগায় দুই তীরে আকাশে লক্ষ তারার দেয়াল। তালাত মাহমুদ গেয়েছেন-দুটি পাখি দুটি তীরে মাঝে নদী বহে ধীরে, এইতো বেশ এই নদীর তীরে বসে গান শোনা।

নদীকে নিয়ে আরও গান আছে যেমন-নদীতে না যাইওরে বন্ধু নদীর ঘোলা পানি; নদী বাঁকা জানি চাঁদ বাঁকা জানি; তারাই গেল বাইয়ারে নদী- ঢেউ উঠছে সাগরে। কমলা ধরিয়া গেয়েছন-তুই যদি গাঙ হোসরে বধূ তাইতে ডুবে মরি, ওরে ও বিদেশি বন্ধু রোজ বেয়ে যাস তরী।

 নদীকে নিয়ে আরও গান যেমন- রূপালী নদীরে রূপ দেইখ্যা তোর, মনরে দুঃখ সুখের দোলায় দোলে ভবনদীর পানি; গৃহকর্ম ত্যাজ্য করে আমি নদীর ঘাটেরে; হাঙ্গোর কুমির বন্ধু আমার নদী কিসের ভয়, ওরাই কৃষ্ণ বিনা প্রাণ বাঁচে না যমুনার ঐ জলেতে- তোমার ভাইটাল বাঁশির সুরের সাথে সাথে কান্দে গাঙের পানি, যমুনা কিনারে শাহ্জাহানে; আমার গাঁয়ের নদীর ঘাটে; সেই চম্পানদীর তীরে! ইত্যাদি আরও কত কি!

কিন্তু এ নদীর ডাকে সাড়া না দিলে শুধু শিল্পীদের গানেই থাকবে। বাস্তবে হারিয়ে যাবে। তবে সবচেয়ে বড় কথা আমাদের দেশকে বাঁচাতে হলে আগে নদী বাঁচাতে হবে। আমরা আশাকরি শিল্পীদের মতো আমরা নদীর ডাকে তাদের বাঁচাতে সাড়া দেব।

লেখক: ড.ফোরকান আলী
গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।